(১)
সকাল থেকে মেয়েটা মায়ের পিছু পিছু ঘুরে বেড়াচ্ছে। পায়ে পায়ে ঘুরতে ঘুরতে এই বেলা এগারোটা বাজল; তবু মায়ের মন গলল না! এবার তো আর ঋজুরও সহ্য হল না। প্রসাদের প্লেটটা ঠকাস করে টি টেবিলের ওপর রেখে বলল, "কি হচ্ছেটা কি? সরস্বতী পুজোর দিন! পাড়ার সব মেয়েরা শাড়ী পরেছে! ও যদি একটু শাড়ী পরতে চাইছে তো দাও না পরিয়ে। তোমার সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি!" কিন্তু মিঠুর সেই এক গোঁ। ------না শাড়ী পরা চলবে না! ও এখনো ছোটো। ---মেয়েও হাল ছাড়ার পাত্রী নয়! এতক্ষণ একাই ঘ্যানঘ্যান করছিল, এবার বাবার সায় পেয়ে আরো যেন মাথায় চাপল। চিৎ্কার করে বলতে লাগল, "শাড়ী না পরতে দিলে আজ আমি সারাদিন কিছু খাবো না "--এই বলে প্রসাদের প্লেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। মিঠুর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। হনহন করে এসে ঠাস করে মেয়ের গালে এক চড় বসিয়ে দিল।---"বাপের আদরে একদম বাঁদর হয়েছ না? খবরদার বলছি অসভ্যতামি করবে না! "
আচমকা মিঠুর এই ব্যবহারে বাপ-মেয়ে দুজনেই ভয় পেয়ে চুপ করে গেল। ঋজু অবাক হয়ে মিঠুর দিকে তাকিয়ে রইল। ঋজুর ওই শ্যেনদৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে মিঠু চোখ নামিয়ে ধীরে ধীরে রান্নাঘরে চলে গেল। কিন্তু মনটা বড্ড কড়কড় করতে লাগল। হিয়া সাত আট বছরের হবার পর থেকে আর কখনো ওর গায়ে হাত তোলেনি মিঠু। হাত তোলার মত কোন কাজ করেও না মেয়েটা। খুব শান্ত না হলেও বেশ বাধ্যের মেয়ে। পড়াশোনাটাও বেশ ভালো করেই করে। অথচ আজ একটা তুচ্ছ কারণে এত বড় মেয়ের গায়ে সে হাত তুলল! একবার বসার ঘরে উঁকি মারল মিঠু। মেয়েটা এখনো বড় বড় জল টলটলে চোখে রান্নাঘরের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। আর থাকতে পারল না। ধীরে ধীরে মেয়ের কাছে গিয়ে তার হাতটা ধরে বলল,----চল । ঋজু ভয় পেয়ে বলল,-----তুমি ওকে আবার মারবে নাকি?---- মিঠু কোন উত্তর না দিয়ে মেয়ের হাত ধরে শোবার ঘরের দিকে চলল।
বেডরুমে নিয়ে এসে হিয়াকে খাটের ওপর বসাল মিঠু। তারপর ছিটকিনি বন্ধ করে এসে নিজেও পাশে বসল। আড়ষ্ট হিয়ার হাতটা টেনে নিজের হাতে নিয়ে মিঠু বলল,-----দেখ হিয়া , তুমি তো আর ছোটো নেই ; যথেষ্ট বড় হয়েছ। ইলেভেনে পড়ছ, বোধবুদ্ধি যথেষ্ট হয়েছে তোমার! তাই আজ তোমাকে একটা ঘটনা বলব আমি; শোন ------ হিয়ার ভয় টা কেটে গিয়ে আশঙ্কার সৃষ্টি হল। কাঁপা গলায় জিগ্গেস করল,"কি হয়েছে মা?" -----আগে শোনো ---- মিঠু শুরু করল,---"তখন আমি টুয়েলভে পড়ি।আজ থেকে কুড়ি বছর আগের কথা।"----- বলতে বলতে মিঠুর কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল। এক এক করে মনে পড়ল সব কথা। কুড়ি বছর আগের সেই দিনটা!--- এমনই এক সরস্বতী পুজোর দিন। --------
--------- কাঁচা হলুদ রঙ্গা একটা শাড়ী লাল ব্লাউজের সাথে পরেছে মিঠু। পাঁচ ছয়জন মেয়ে পাড়ার প্যান্ডেলের সামনে বসে খিলখিল করছিল। এমন সময় একটা বাচ্চা এসে বলল," ও মিঠুদি, তোমাকে ডাকছে।"
----কে রে? কে ডাকছে?
----ওই তো ওখানে, সঞ্জয়দা
মেয়ের দল দেখল প্যান্ডেলের পেছনে সঞ্জয় ওদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।হাসির রোল উঠল। লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে গেল মিঠু। বান্ধবীরা ঠেলে বলল,----যা না, কি বলছে শুনেই আয়----
মিঠু কাছে যেতেই সঞ্জয় বলল," তোর সঙ্গে কথা আছে, একটু এদিকে আসবি? প্যান্ডেলের পেছনে।" মিঠু আরেকটু এগিয়ে প্যান্ডেলের পিছনের দিকে গিয়ে বলল, "কি বলবে বল।"
কোন ভনিতা না করে হঠাৎ সঞ্জয় মিঠুর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে গড়গড় করে বলতে শুরু করল-----"দেখ মিঠু, আমি ন্যাকামি করতে পারি না, তাই সোজা কথা সোজা করে বলছি, আমি তোকে খুব ভালবাসি, তোকে ছাড়া বাঁচব না, তুই যদি না বলিস তাহলে সরস্বতী বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গে আমারও লাশ বেরাবে।"
এতগুলো কথা এক নিঃশ্বাসে বলে সঞ্জয় তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল------বল এবার তোর কি উত্তর-----
মিঠু তোতলাতে তোতলাতে বলল,----মম্মানে? কক্কি বলছ?
------"অ্যাঁ তুই এতক্ষণ কিছুই শুনিস নি?"--বলেই সঞ্জয় মিঠুর ডান হাতটা দুই হাতে ধরে বলল, "দেখ, আবার বলছি, আমি তোকে ভালবাসি, তুই আমাকে ভালবাসিস কিনা বল"
মিঠু আস্তে আস্তে সঞ্জয়ের হাত থেকে নিজের হাত টা ছাড়িয়ে নিয়ে "যাহ্ " বলে ছুটে পালালো।
ছোট পিসিমণির ননদের বিয়ের আইবুড়ো ভাত আজ। বাবা, মা আর ভাই তিনজনেই সকাল থেকেই পিসিমণির বাড়িতে। মিঠুর সামনে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা বলে সে আজ যায় নি, কাল বিয়েতে যাবে। পড়ায় কিন্তু একটুও মন বসছে না তার। অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করে ঘর-বারান্দা করছে। গত এক সপ্তাহ ধরে পড়াশোনা মাথায় উঠেছে। সরস্বতী পুজোর দিন সঞ্জয়দা যেভাবে তাকে প্রপোজ করল! তারপর থেকে রোজ সন্ধ্যেবেলা টিউশন পড়তে যাবার সময় তারা দেখা করে। কাল যখন মিঠু বলল আজ সারাদিন সে একা থাকবে, বাড়িতে কেউ থাকবে না, স্কুলও নেই; তখন সঞ্জয় নিজেই বলেছিল-----" ঠিক আছে, কাল আমি তোর বাড়ি যাবো, অনেক গল্প করব। " ----দেড়টা বাজল, এখনো সঞ্জয়টা এল না! ভাবতে ভাবতে বুঝি একটু চোখই লেগে গেছিল; এমন সময় দরজায় মৃদু টোকা পড়ল। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে মিঠু দেখল সঞ্জয় দাঁড়িয়ে। মিঠু গাল ফুলিয়ে বলল," এত দেরি করলে যে বড়?"
---কি করব? তোর পাশের বাড়ির বুড়িটা ঘুমায়ইনা! কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি। আমাকে তোদের বাড়িতে ঢুকতে দেখলে বলে দেবে না সবাইকে! তাই তো লুকিয়ে এলাম।
মিঠু দরজা বন্ধ করে সঞ্জয়ের হাত ধরে বলল, "চলো, আমার ঘরে গিয়ে বসি।"
মিঠুর ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক দেখে সঞ্জয় বলল, "বাব্বা, কত পুতুল সাজিয়ে রেখেছিস সারা ঘরে! তুই কি এখনো এসব নিয়ে খেলা করিস নাকি? "
-----কি যে বলো, ওগুলো আমার ছোটবেলার খেলনা, এখন আমি বড় হয়ে গেছি বুঝলে?
সঞ্জয় খাটের ওপর হেলান দিয়ে বসে বলল, " হুমম, বড় হয়ে গেছিস? তাহলে প্রমাণ কর। "
----মানে ?
----মানে এখন আমার একটা কিস চাই
----যাহ্! তুমি না খুব অসভ্য!
----ওসব শুনব না। বড় হয়েছিস প্রমাণ কর!------বলেই সঞ্জয় মিঠুর হাতটা ধরে হ্যাঁচকা টান মারল।
মিঠু ছুটে গিয়ে সঞ্জয়ের বুকে পড়ল। সঞ্জয় আষ্টেপৃষ্ঠে মিঠুকে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে সুধা পান করতে লাগল। ওই বাহুপাশ থেকে মিঠু আর নিজেকে ছাড়াতে পারল না। উন্মুক্ত হতে লাগল দুজনেই। অতলে, আরো অতলে তলিয়ে গেল মিঠু। আর সঞ্জয় যেন শৃঙ্গ জয়ের আনন্দে ভরিয়ে তুলতে লাগল নিজেকে আর মিঠুকে।
(২)
সঞ্জয়ের বুকে মাথা দিয়ে আবেগঘন স্বরে মিঠু বলল," এভাবেই সারাজীবন আমায় ভালবাসবে তো সঞ্জয়দা?" মিঠুর চুলে বিলি কাটতে কাটতে সঞ্জয় আনমনে বলল," হুমম "
------আচ্ছা আমরা বিয়ে কবে করব সঞ্জয়দা ? তুমি এসে বাবাকে বলবে তো? বাবা যদি না রাজি হয়? তোমার বাড়ির সবাই মানবে তো?
------কি যা তা বলছিস?--- সঞ্জয় গা ঝাড়া দিয়ে উঠল, " তুই তো একেবারে বিয়ে পর্যন্ত পৌঁছে গেলি!"
------মানে?
------মানে তোর মত একটা প্র্যাকটিক্যাল মেয়ের কাছে এধরনের ন্যাকা ন্যাকা কথা আমি আশা করিনা মিঠু!
------তুমি কি বলছ সঞ্জয়দা আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
------শোন, গত দুবছর ধরে তুই সরস্বতী পুজোয় শাড়ী পরছিস, আর তাই দেখে পাড়ার প্রত্যেকটা ছেলে পাগল হয়ে গেছে জানিস? শাড়ীর ফাঁক থেকে বেরিয়ে থাকা তোর ওই কোমর! ওফ্ফ্! তুই জানিস তোর ওই কোমরের খাঁজে পাড়ার প্রতিটা ছেলের মন আটকে রয়েছে দুবছর ধরে?--- কিন্তু এবছর আমি ওদেরকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলাম, তোকে তুলবোই। আর দেখ, তুই আমাকে কেমন জিতিয়ে দিলি! থ্যাংকস রে ।
মিঠুর গলার কাছে অনেকখানি বাষ্প জমে যেন ওর কণ্ঠরোধ করে দিল। ফিসফিস করে বলল," তুমি আমাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলে সঞ্জয়দা? আমি কিন্তু তোমাকে সত্যি খুব ভালবেসেছি।"
------দেখ, ওসব ভালবাসা টালোবাসা বলে সিন ক্রিয়েট করিস না।---- ঝাঁজিয়ে উঠল সঞ্জয়-----আমি ওসব ভালবাসায় বিশ্বাস করিনা। দুদিন আনন্দ করলাম দুজনে একটু। ব্যাস! ওইটুকুই! যা হয়েছে দুজনের সম্মতিতেই হয়েছে। তুই বলতে পারবিনা কিন্তু যে আমি তোর ফায়দা নিয়েছি! আর তোকে আমি কোন বিপদেও ফেলতে চায় না; তাই আগে থেকেই প্রটেকশন সঙ্গে নিয়েই এসেছিলাম।---- বলে সঞ্জয় পকেট থেকে গোলাপি রঙ্গের ছোটো প্যাকেটটা বের করে দেখায়।
মিঠুর চোখের জল আর বাঁধ মানে না। সঞ্জয়ের হাতটা ধরে বলে, " তুমি মজা করছ না আমার সঙ্গে? বলো?"
হাতটা ধীরে ধীরে ছাড়িয়ে নিয়ে সঞ্জয় কঠিন শান্ত স্বরে বলে," আমি একটুও মজা করছিনা। যা হবার হয়েছে, এবার তুই তোর রাস্তায় আমি আমার রাস্তায়। মনের মধ্যে কোন কিছু রাখিস না। পুজো তো আবার আসবে। যদি সব ঠিকঠাক থাকে তাহলে নাহয়----আসছে বছর আবার হবে!"
---------- না,আসছে বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি মিঠুকে। ছোটো পিসিমণির ননদের বিয়েতেই একটি ভালো পাত্রের সন্ধান বাবা পেয়ে গেছিলেন। ইংজিনিযর ছেলে, ভালো চাকরি; মিঠুকে তাদের ভারি পছন্দও হল। তাই উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষাটা শেষ হতেই চার হাত এক করে দিলেন বাবা।
মিঠুর গাল বেয়ে গড়িয়ে আসা জল নিজের হাতে মুছে দিতে দিতে হিয়া জিগ্গেস করল,---- "তুমি এখনো ঐ লোকটাকে খুব ভালোবাসো না মা?"
মিঠু সম্বিত ফিরে অবাক চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,----" ভালোবাসি? কই না তো!"
------তাহলে এখনো যে ওই লোকটার কথা ভেবে কাঁদছ!
------ওর কথা ভেবে কাঁদিনি মা, আমি নিজের কথা ভেবে কাঁদছি। কোন পুরুষ মানুষের কাছে ভোগ্যবস্তু হওয়ার, শুধুমাত্র ব্যবহারের সামগ্রী হওয়ার অপমানটা যে কি; কি সেই জ্বালা তা তোকে বোঝাতে পারবনা না মা। আমি পেরেছি সেই জ্বালা সহ্য করতে, তুই যদি না পারিস? যদি কেউ তোকেও....
কথা শেষ করতে পারে না মিঠু, কান্নায় বুজে আসে গলা।
মা-মেয়ে অনেকক্ষণ হাত ধরে চুপ করে বসে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে উঠে মিঠু আলমারি থেকে জামরঙ্গা জামদানিটা বের করে নিয়ে এসে হিয়ার হাতে দেয়;------- এটাই তো পড়তে চাইছিলি সকাল থেকে? আয় পড়িয়ে দিই। তোকে নিজের হাতে সাজিয়ে দিই।
মেয়েকে শাড়ী পড়িয়ে সাজিয়ে নিয়ে যখন শোবার ঘর থেকে বেরালো মিঠু তখন ওদেরকে দেখে ঋজুর মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মিঠু মেয়েকে বলল, " যা, প্যান্ডেলে যা"
হিয়া আনন্দে একছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। কিন্তু পরক্ষণেই ফিরে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, " তুমি ভেবো না মা, আমাকে কোন ছেলে ব্যবহার করতে পারবে না, আমি সে সুযোগ দেব না। কেউ কোন দিন আমাকে বলতে পারবে না -------আসছে বছর আবার হবে! "
মিঠু হাতটা মেয়ের মাথায় বুলিয়ে হাসিমুখ বলল, "যা... বন্ধুরা অপেক্ষা করছে।"
_____________________________________
© মমতা সিনহা
সকাল থেকে মেয়েটা মায়ের পিছু পিছু ঘুরে বেড়াচ্ছে। পায়ে পায়ে ঘুরতে ঘুরতে এই বেলা এগারোটা বাজল; তবু মায়ের মন গলল না! এবার তো আর ঋজুরও সহ্য হল না। প্রসাদের প্লেটটা ঠকাস করে টি টেবিলের ওপর রেখে বলল, "কি হচ্ছেটা কি? সরস্বতী পুজোর দিন! পাড়ার সব মেয়েরা শাড়ী পরেছে! ও যদি একটু শাড়ী পরতে চাইছে তো দাও না পরিয়ে। তোমার সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি!" কিন্তু মিঠুর সেই এক গোঁ। ------না শাড়ী পরা চলবে না! ও এখনো ছোটো। ---মেয়েও হাল ছাড়ার পাত্রী নয়! এতক্ষণ একাই ঘ্যানঘ্যান করছিল, এবার বাবার সায় পেয়ে আরো যেন মাথায় চাপল। চিৎ্কার করে বলতে লাগল, "শাড়ী না পরতে দিলে আজ আমি সারাদিন কিছু খাবো না "--এই বলে প্রসাদের প্লেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। মিঠুর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। হনহন করে এসে ঠাস করে মেয়ের গালে এক চড় বসিয়ে দিল।---"বাপের আদরে একদম বাঁদর হয়েছ না? খবরদার বলছি অসভ্যতামি করবে না! "
আচমকা মিঠুর এই ব্যবহারে বাপ-মেয়ে দুজনেই ভয় পেয়ে চুপ করে গেল। ঋজু অবাক হয়ে মিঠুর দিকে তাকিয়ে রইল। ঋজুর ওই শ্যেনদৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে মিঠু চোখ নামিয়ে ধীরে ধীরে রান্নাঘরে চলে গেল। কিন্তু মনটা বড্ড কড়কড় করতে লাগল। হিয়া সাত আট বছরের হবার পর থেকে আর কখনো ওর গায়ে হাত তোলেনি মিঠু। হাত তোলার মত কোন কাজ করেও না মেয়েটা। খুব শান্ত না হলেও বেশ বাধ্যের মেয়ে। পড়াশোনাটাও বেশ ভালো করেই করে। অথচ আজ একটা তুচ্ছ কারণে এত বড় মেয়ের গায়ে সে হাত তুলল! একবার বসার ঘরে উঁকি মারল মিঠু। মেয়েটা এখনো বড় বড় জল টলটলে চোখে রান্নাঘরের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। আর থাকতে পারল না। ধীরে ধীরে মেয়ের কাছে গিয়ে তার হাতটা ধরে বলল,----চল । ঋজু ভয় পেয়ে বলল,-----তুমি ওকে আবার মারবে নাকি?---- মিঠু কোন উত্তর না দিয়ে মেয়ের হাত ধরে শোবার ঘরের দিকে চলল।
বেডরুমে নিয়ে এসে হিয়াকে খাটের ওপর বসাল মিঠু। তারপর ছিটকিনি বন্ধ করে এসে নিজেও পাশে বসল। আড়ষ্ট হিয়ার হাতটা টেনে নিজের হাতে নিয়ে মিঠু বলল,-----দেখ হিয়া , তুমি তো আর ছোটো নেই ; যথেষ্ট বড় হয়েছ। ইলেভেনে পড়ছ, বোধবুদ্ধি যথেষ্ট হয়েছে তোমার! তাই আজ তোমাকে একটা ঘটনা বলব আমি; শোন ------ হিয়ার ভয় টা কেটে গিয়ে আশঙ্কার সৃষ্টি হল। কাঁপা গলায় জিগ্গেস করল,"কি হয়েছে মা?" -----আগে শোনো ---- মিঠু শুরু করল,---"তখন আমি টুয়েলভে পড়ি।আজ থেকে কুড়ি বছর আগের কথা।"----- বলতে বলতে মিঠুর কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল। এক এক করে মনে পড়ল সব কথা। কুড়ি বছর আগের সেই দিনটা!--- এমনই এক সরস্বতী পুজোর দিন। --------
--------- কাঁচা হলুদ রঙ্গা একটা শাড়ী লাল ব্লাউজের সাথে পরেছে মিঠু। পাঁচ ছয়জন মেয়ে পাড়ার প্যান্ডেলের সামনে বসে খিলখিল করছিল। এমন সময় একটা বাচ্চা এসে বলল," ও মিঠুদি, তোমাকে ডাকছে।"
----কে রে? কে ডাকছে?
----ওই তো ওখানে, সঞ্জয়দা
মেয়ের দল দেখল প্যান্ডেলের পেছনে সঞ্জয় ওদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।হাসির রোল উঠল। লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে গেল মিঠু। বান্ধবীরা ঠেলে বলল,----যা না, কি বলছে শুনেই আয়----
মিঠু কাছে যেতেই সঞ্জয় বলল," তোর সঙ্গে কথা আছে, একটু এদিকে আসবি? প্যান্ডেলের পেছনে।" মিঠু আরেকটু এগিয়ে প্যান্ডেলের পিছনের দিকে গিয়ে বলল, "কি বলবে বল।"
কোন ভনিতা না করে হঠাৎ সঞ্জয় মিঠুর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে গড়গড় করে বলতে শুরু করল-----"দেখ মিঠু, আমি ন্যাকামি করতে পারি না, তাই সোজা কথা সোজা করে বলছি, আমি তোকে খুব ভালবাসি, তোকে ছাড়া বাঁচব না, তুই যদি না বলিস তাহলে সরস্বতী বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গে আমারও লাশ বেরাবে।"
এতগুলো কথা এক নিঃশ্বাসে বলে সঞ্জয় তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল------বল এবার তোর কি উত্তর-----
মিঠু তোতলাতে তোতলাতে বলল,----মম্মানে? কক্কি বলছ?
------"অ্যাঁ তুই এতক্ষণ কিছুই শুনিস নি?"--বলেই সঞ্জয় মিঠুর ডান হাতটা দুই হাতে ধরে বলল, "দেখ, আবার বলছি, আমি তোকে ভালবাসি, তুই আমাকে ভালবাসিস কিনা বল"
মিঠু আস্তে আস্তে সঞ্জয়ের হাত থেকে নিজের হাত টা ছাড়িয়ে নিয়ে "যাহ্ " বলে ছুটে পালালো।
ছোট পিসিমণির ননদের বিয়ের আইবুড়ো ভাত আজ। বাবা, মা আর ভাই তিনজনেই সকাল থেকেই পিসিমণির বাড়িতে। মিঠুর সামনে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা বলে সে আজ যায় নি, কাল বিয়েতে যাবে। পড়ায় কিন্তু একটুও মন বসছে না তার। অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করে ঘর-বারান্দা করছে। গত এক সপ্তাহ ধরে পড়াশোনা মাথায় উঠেছে। সরস্বতী পুজোর দিন সঞ্জয়দা যেভাবে তাকে প্রপোজ করল! তারপর থেকে রোজ সন্ধ্যেবেলা টিউশন পড়তে যাবার সময় তারা দেখা করে। কাল যখন মিঠু বলল আজ সারাদিন সে একা থাকবে, বাড়িতে কেউ থাকবে না, স্কুলও নেই; তখন সঞ্জয় নিজেই বলেছিল-----" ঠিক আছে, কাল আমি তোর বাড়ি যাবো, অনেক গল্প করব। " ----দেড়টা বাজল, এখনো সঞ্জয়টা এল না! ভাবতে ভাবতে বুঝি একটু চোখই লেগে গেছিল; এমন সময় দরজায় মৃদু টোকা পড়ল। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে মিঠু দেখল সঞ্জয় দাঁড়িয়ে। মিঠু গাল ফুলিয়ে বলল," এত দেরি করলে যে বড়?"
---কি করব? তোর পাশের বাড়ির বুড়িটা ঘুমায়ইনা! কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি। আমাকে তোদের বাড়িতে ঢুকতে দেখলে বলে দেবে না সবাইকে! তাই তো লুকিয়ে এলাম।
মিঠু দরজা বন্ধ করে সঞ্জয়ের হাত ধরে বলল, "চলো, আমার ঘরে গিয়ে বসি।"
মিঠুর ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক দেখে সঞ্জয় বলল, "বাব্বা, কত পুতুল সাজিয়ে রেখেছিস সারা ঘরে! তুই কি এখনো এসব নিয়ে খেলা করিস নাকি? "
-----কি যে বলো, ওগুলো আমার ছোটবেলার খেলনা, এখন আমি বড় হয়ে গেছি বুঝলে?
সঞ্জয় খাটের ওপর হেলান দিয়ে বসে বলল, " হুমম, বড় হয়ে গেছিস? তাহলে প্রমাণ কর। "
----মানে ?
----মানে এখন আমার একটা কিস চাই
----যাহ্! তুমি না খুব অসভ্য!
----ওসব শুনব না। বড় হয়েছিস প্রমাণ কর!------বলেই সঞ্জয় মিঠুর হাতটা ধরে হ্যাঁচকা টান মারল।
মিঠু ছুটে গিয়ে সঞ্জয়ের বুকে পড়ল। সঞ্জয় আষ্টেপৃষ্ঠে মিঠুকে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে সুধা পান করতে লাগল। ওই বাহুপাশ থেকে মিঠু আর নিজেকে ছাড়াতে পারল না। উন্মুক্ত হতে লাগল দুজনেই। অতলে, আরো অতলে তলিয়ে গেল মিঠু। আর সঞ্জয় যেন শৃঙ্গ জয়ের আনন্দে ভরিয়ে তুলতে লাগল নিজেকে আর মিঠুকে।
(২)
সঞ্জয়ের বুকে মাথা দিয়ে আবেগঘন স্বরে মিঠু বলল," এভাবেই সারাজীবন আমায় ভালবাসবে তো সঞ্জয়দা?" মিঠুর চুলে বিলি কাটতে কাটতে সঞ্জয় আনমনে বলল," হুমম "
------আচ্ছা আমরা বিয়ে কবে করব সঞ্জয়দা ? তুমি এসে বাবাকে বলবে তো? বাবা যদি না রাজি হয়? তোমার বাড়ির সবাই মানবে তো?
------কি যা তা বলছিস?--- সঞ্জয় গা ঝাড়া দিয়ে উঠল, " তুই তো একেবারে বিয়ে পর্যন্ত পৌঁছে গেলি!"
------মানে?
------মানে তোর মত একটা প্র্যাকটিক্যাল মেয়ের কাছে এধরনের ন্যাকা ন্যাকা কথা আমি আশা করিনা মিঠু!
------তুমি কি বলছ সঞ্জয়দা আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
------শোন, গত দুবছর ধরে তুই সরস্বতী পুজোয় শাড়ী পরছিস, আর তাই দেখে পাড়ার প্রত্যেকটা ছেলে পাগল হয়ে গেছে জানিস? শাড়ীর ফাঁক থেকে বেরিয়ে থাকা তোর ওই কোমর! ওফ্ফ্! তুই জানিস তোর ওই কোমরের খাঁজে পাড়ার প্রতিটা ছেলের মন আটকে রয়েছে দুবছর ধরে?--- কিন্তু এবছর আমি ওদেরকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলাম, তোকে তুলবোই। আর দেখ, তুই আমাকে কেমন জিতিয়ে দিলি! থ্যাংকস রে ।
মিঠুর গলার কাছে অনেকখানি বাষ্প জমে যেন ওর কণ্ঠরোধ করে দিল। ফিসফিস করে বলল," তুমি আমাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলে সঞ্জয়দা? আমি কিন্তু তোমাকে সত্যি খুব ভালবেসেছি।"
------দেখ, ওসব ভালবাসা টালোবাসা বলে সিন ক্রিয়েট করিস না।---- ঝাঁজিয়ে উঠল সঞ্জয়-----আমি ওসব ভালবাসায় বিশ্বাস করিনা। দুদিন আনন্দ করলাম দুজনে একটু। ব্যাস! ওইটুকুই! যা হয়েছে দুজনের সম্মতিতেই হয়েছে। তুই বলতে পারবিনা কিন্তু যে আমি তোর ফায়দা নিয়েছি! আর তোকে আমি কোন বিপদেও ফেলতে চায় না; তাই আগে থেকেই প্রটেকশন সঙ্গে নিয়েই এসেছিলাম।---- বলে সঞ্জয় পকেট থেকে গোলাপি রঙ্গের ছোটো প্যাকেটটা বের করে দেখায়।
মিঠুর চোখের জল আর বাঁধ মানে না। সঞ্জয়ের হাতটা ধরে বলে, " তুমি মজা করছ না আমার সঙ্গে? বলো?"
হাতটা ধীরে ধীরে ছাড়িয়ে নিয়ে সঞ্জয় কঠিন শান্ত স্বরে বলে," আমি একটুও মজা করছিনা। যা হবার হয়েছে, এবার তুই তোর রাস্তায় আমি আমার রাস্তায়। মনের মধ্যে কোন কিছু রাখিস না। পুজো তো আবার আসবে। যদি সব ঠিকঠাক থাকে তাহলে নাহয়----আসছে বছর আবার হবে!"
---------- না,আসছে বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি মিঠুকে। ছোটো পিসিমণির ননদের বিয়েতেই একটি ভালো পাত্রের সন্ধান বাবা পেয়ে গেছিলেন। ইংজিনিযর ছেলে, ভালো চাকরি; মিঠুকে তাদের ভারি পছন্দও হল। তাই উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষাটা শেষ হতেই চার হাত এক করে দিলেন বাবা।
মিঠুর গাল বেয়ে গড়িয়ে আসা জল নিজের হাতে মুছে দিতে দিতে হিয়া জিগ্গেস করল,---- "তুমি এখনো ঐ লোকটাকে খুব ভালোবাসো না মা?"
মিঠু সম্বিত ফিরে অবাক চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,----" ভালোবাসি? কই না তো!"
------তাহলে এখনো যে ওই লোকটার কথা ভেবে কাঁদছ!
------ওর কথা ভেবে কাঁদিনি মা, আমি নিজের কথা ভেবে কাঁদছি। কোন পুরুষ মানুষের কাছে ভোগ্যবস্তু হওয়ার, শুধুমাত্র ব্যবহারের সামগ্রী হওয়ার অপমানটা যে কি; কি সেই জ্বালা তা তোকে বোঝাতে পারবনা না মা। আমি পেরেছি সেই জ্বালা সহ্য করতে, তুই যদি না পারিস? যদি কেউ তোকেও....
কথা শেষ করতে পারে না মিঠু, কান্নায় বুজে আসে গলা।
মা-মেয়ে অনেকক্ষণ হাত ধরে চুপ করে বসে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে উঠে মিঠু আলমারি থেকে জামরঙ্গা জামদানিটা বের করে নিয়ে এসে হিয়ার হাতে দেয়;------- এটাই তো পড়তে চাইছিলি সকাল থেকে? আয় পড়িয়ে দিই। তোকে নিজের হাতে সাজিয়ে দিই।
মেয়েকে শাড়ী পড়িয়ে সাজিয়ে নিয়ে যখন শোবার ঘর থেকে বেরালো মিঠু তখন ওদেরকে দেখে ঋজুর মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মিঠু মেয়েকে বলল, " যা, প্যান্ডেলে যা"
হিয়া আনন্দে একছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। কিন্তু পরক্ষণেই ফিরে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, " তুমি ভেবো না মা, আমাকে কোন ছেলে ব্যবহার করতে পারবে না, আমি সে সুযোগ দেব না। কেউ কোন দিন আমাকে বলতে পারবে না -------আসছে বছর আবার হবে! "
মিঠু হাতটা মেয়ের মাথায় বুলিয়ে হাসিমুখ বলল, "যা... বন্ধুরা অপেক্ষা করছে।"
_____________________________________
© মমতা সিনহা
No comments:
Post a Comment