এক একটা লোক থাকে যাদের নেশা হচ্ছে কোথায় সস্তায় জমি পাওয়া যাচ্ছে , কোথায় ভালো এরিয়াতে ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে , তার সব দাম হিসাব নিকাশ করে লোককে বুঝিয়ে দেওয়া। তারা অবশ্য এতে কোনো দালালি বা কমিশন নেয়না। অন্যকে এই সব বাড়ি ঘর কেনার ব্যাপারে উৎসাহিত করা যেন এদের বেঁচে থাকার সুখ। বিনয়কাকু তেমনি একজন মানুষ। বিনয়কাকু আমার বাবার যেমন বন্ধু তেমনি নীলুর বাবার খুব পরিচিত। দু বাড়িতেই আনাগোনা। একদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে দেখি , বিনয়কাকু বাবাকে বোঝাচ্ছেন যে আমার চাকরি জীবনের শুরুতেই ফ্ল্যাট বুক করে ফেলা উচিৎ। এখন যখন দায় দায়িত্ব কম তখন ফ্ল্যাটের মাসিক কিস্তি মেটানো সহজ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার বাবা আবার আমার মতন। এই সব বিষয় আসয়ে কোনো রকমের ইন্টারেস্ট নেই। আমি আসতেই বিনয়কাকুকে বললেন - আপনার যা বোঝানোর ওকেই বুঝিয়ে দিন। তারপর আমাকে বাধ্য হয়ে শুনতে হলো মধ্যমগ্রাম থেকে টালিগঞ্জ পর্যন্ত কোথায় কোন ভালো ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে , কি তার সাইজ , কত দাম , কোথা থেকে কম সুদে লোন পাওয়া যাবে এইসব হাবিজাবি। আমি বেশ কিছুক্ষণ শুনে মাথা নেড়ে উঠে যাই।
এর কিছুদিন পরে নীলুদের বাড়ি গিয়ে দেখি বিনয়কাকু নীলু আর ওর বাবাকে বোঝাচ্ছেন আমার কেন এখুনি ফ্ল্যাট কেনা উচিত। উনি দেখি একটা কাগজে খসখস করে লিখে দিলেন লেক টাউনে এক ভদ্রলোকের ঠিকানা। উনি লেকটাউন অনেকগুলি মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং করছ্রন। সেখানে এখনো অনেক ফ্ল্যাট বুক হয়নি। নীলু দেখি খুব আগ্রহ নিয়ে সব জেনে নিচ্ছে। আমি বসে বসে এদিকে বোর হচ্ছি। কিছুক্ষণ পরে বিনয়কাকু উঠলে আমি হাঁফ ছেড়ে বলি , ' তুই ফ্ল্যাট কিনছিস ?' নীলু উত্তর দেয় , ' ভবিষ্যৎ , ভবিষ্যৎ। তোমার ভবিষ্যৎকে উজ্বল করার ভার তো আমাকেই নিতে হবে। চলো কাল রবিবার আছে। দুজনে মিলে ঘুরে আসি লেক টাউন থেকে। কিছু হোক বা না হোক , কম পক্ষে বেড়ানোতো হবে। ' নীলুর সঙ্গে বেড়ানোর ব্যাপারে আমি একপায়ে খাড়া। কাজেই ফ্ল্যাট কেনার মতন ভজকটর ব্যাপারে উৎসাহ না থাকলেও রাজি হয়ে যাই।
রবিবার সকালে ট্রেন বাস পালটে আমি আর নীলু পৌঁছাই লেক টাউনে। খুঁজে বার করি সেই বিল্ডার স্বপনবাবুর বাড়ি। ওঁর ফ্ল্যাটে গিয়ে কলিং বেল বাজাতেই যিনি খুললেন তিনি যে স্বপনবাবু তা বুঝতে এক সেকন্ড ও লাগেনি। সেই সকাল এগারোটায় মাঝবয়সী , পেটমোটা , মাথায় এক বড় চাঁদিয়াল টাক , পরনে সাদা ধবধবে পায়জামা পাঞ্জাবি , দু হাতে গোটা আটক বড় বড় সোনার আংটি , যাতে বিভিন্ন রঙের পাথর ঝলসাচ্ছে। দেখেই বোঝা যায় কালো টাকার গদিতে শুয়ে শুয়ে দিন কাটে এনাদের। আমাদের দেখেই শুরু হলো প্রশ্ন , কোথায় চাকরি করি , সরকারি না বেসরকারি চাকরি , বুকিংএর টাকা সাদায় না কালোতে দেবো। আমি যখন জানালাম যে কোম্পানির লোন ছাড়া আর আমার রেস্তে কিছুই নেই এবং কোম্পানির আইন অনুযায়ী কোম্পানি পুরো টাকাটা চেকে দেবে ওঁর নামে , দেখলাম ভদ্রলোক একটু ঝিমিয়ে পড়লেন। তারপর দেখি নীলুকে বলছেন , ' এতো সাদা টাকার কথা বললে কি আর ফ্ল্যাট কেনা যায়। তবুও আপনাদের সংসারে যাতে সুখ আসে , আমি আপনাদের পুরো সাদা টাকায় বাড়ি বেচতে রাজি। ' এরপর ওঁর ফ্ল্যাট যেখানে হচ্ছে সেখানে যাওয়ার রাস্তা বলে দিলেন। সেখানে ওঁর ম্যানেজার আছেন সেই সব ফ্ল্যাট দেখিয়ে দেবে।
স্বপনবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে নীলু বলে , ' আমরা কি সুখের খোঁজে এসেছি?' আমি বলি , সে তুই জানিস। তুই আমাকে এখানে টেনে আনলি , কাজেই তুই জানিস আমরা এখানে কিসের খোঁজে এসেছি। ' গিয়ে দেখি পাঁচতলা বাড়ির চারতলা পর্যন্ত হয়ে গেছে। সারা বাড়িটা তার ইট কাঠের খাঁচা নিয়ে কেমন এক কঙ্কালের মতন দাঁড়িয়ে আছি। আমি সে কথা বলতে যাবো , তার আগেই নীলু বলে , ' বাড়িটাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন মিউজিয়ামে ঝোলানো তিমি মাছের কঙ্কাল। বিশাল আকার নিয়ে হাড় গোড় বার করে শুয়ে আছে। ' ওই বিল্ডারের ম্যানেজার আমাদের নিয়ে গেলো চার তলায়। ছোট দু কামরার ফ্ল্যাট। সদ্য কেবল ছাদ ঢালাই হয়েছে। সেই খোলা জায়গায় লোকটা বোঝাতে থাকে কোথায় বেডরুম , কোথায় ড্রইং রুম , কোথায় কিচেন স্পেস। দেখি নীলু কেমন উদাস ভাবে শুনে যাচ্ছে। বুঝতে পারছি কোনো কিছুই মন দিয়ে শুনছেনা। সব বুঝিয়ে বাঝিয়ে ম্যানেজার বাবু বললেন , ' আপনারা ভালোকরে চারপাশটা দেখেনিন চার তোলা থেকে কেমন দেখাচ্ছে , আমি নিচে আছি। ‘
লোকটা চলে যাওয়ার পরে নীলু প্রশ্ন করে , ' আচ্ছা আমরা কার জন্য ফ্ল্যাট দেখতে এসেছি ? ' আমি অবাক হয়ে বলি , ' আমিতো ভাবলাম তুই বিয়ের পর গুছিয়ে ঘর সংসার করতে চাস , তাই এখন থেকে ফ্ল্যাটের জোগাড় যন্ত্র করছিস। ' নীলু উল্টে আমাকে প্রশ্ন করে , ' তুমি কি চাও সুখ না আনন্দ ?' আমি বলি , ' দেখ আমি এই খেলা শুরু করিনি। কাজেই তুই বল তুই কি চাস ?' নীলু কিছু না বলে পা বাড়ায়।
বিধাননগর স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরে ফিরবো। কিন্তু বিধাননগর স্টেশনে পৌঁছতেই দেখি বাজে বেলা দেড়টা। নীলু বলে ক্ষিদে পেয়েছে। তাই বলে, ' চলো কোথাও বসে ভাত মাছ খেয়ে যাই। ' ওই স্টেশন চত্বরে ভালো কোনো রেস্টুরেন্ট নেই যেখানে বসে একটু আয়েস করে খাওয়া যাবে। দুজনে হেঁটে দোকান খুঁজতে গিয়ে দেখি রাস্তার ধারে একটা খুপচি দোকান। স্টেশনে যাওয়া আসা করা খেটে খাওয়া লোকদের জন্য সস্তায় খাওয়ার ব্যবস্থা। আমি কিছু বলার আগেই নীলু দোকানে ঢুকে পড়লো। গিয়ে দেখি পর পর কাঠের টেবিল সাজানো। দুদিকে বেঞ্চি পাতা। তাতে হেলান দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। এদিক ওদিক ক্লান্ত শ্রান্ত লোকজন খাচ্ছে। আমাদের ঢুকতে দেখেই দোকানি এক ধারের টেবিল বেঞ্চি তার কাঁধের গামছা দিয়ে মুছে আমাদের বসতে বললো। ওই স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা লোকটাকে কেন কি জানি ভালো লেগে গেলো। তখন আমারও বেশ ক্ষিদে পেয়েছিলো। এই ধরণের দোকানে মাঝে মধ্যে বাধ্য হয়ে আমি খেয়েছি। কিন্তু নীলু নিশ্চয় কোনোদিন এমন দোকানে ঢুকে খায়নি। বুঝতে পারছি ওর মাথায় কিছু ঘুরছে। তাই ওর মনে কোনো বাছ বিচার কাজ করছেনা । নেহাত ক্ষিদে পেয়েছে বলেই যেন ঢোকা। দুজনে বসতেই দোকানি জিজ্ঞেস করে কি খাবো। আমি কিছু বলার আগেই নীলু বলে , ' ভাত খাবো। তার সঙ্গে যা আপনাদের ভালো আইটেম আছে সেটা দেবেন। ' লোকটা মুখে একটা আকর্নলম্বিত হাসি দিয়ে বলে , ' তবে একটু বসতে হবে। মনের মতো খাওয়াতে একটু সময় লাগবে। '
দোকানি ভিতরে রান্না ঘরে গেলো ওর রাঁধুনীকে নির্দেশ দিতে। আমি আর নীলু চুপ করে বসে আছি। হটাৎ নীলু বলে , ' আমরা সুখ আর আনন্দকে গুলিয়ে ফেলছি নাকি ? তোমার বদলির চাকরি , প্রতি তিন চার বছরে এক শহর থেকে আর এক শহরে ঘুরবে। তবে এক জায়গায় খোঁটা বেঁধে কি লাভ ? ' আমি ভাবি সেতো সত্যি কথা। তবুও আমি বলি , ' কিন্তু তুই তো চাকরি করবি। তুই এখানে থাকবি আর আমি ঘুরে বেড়াবো। ' নীলু টেবিলের তলায় ওর পা দিয়ে আমার চটি পরা পা টাকে মাড়িয়ে দিয়ে বলে , ' ইল্লিরে , বাবু ঘুরে বেড়াবেন, আর আমি এখানে পড়ে থাকবো। সে সব নেহি চলেগা। আমি ভূক হরতাল করেগা। তুমি যেখানে যাবে সেখানেই আমি চাকরি খুঁজে নেবো। ফ্ল্যাট বুকিং ক্যানসেল। '
ততক্ষণে দেখি দোকানের ছেলেটা খাবার সার্ভ করে দিয়েছে। ভাত, ডাল , মাছের ঝোলের সঙ্গে একটা বড় মাছের মাথা ভেজে দুজনকে এক এক ফালি মাথা দিয়েছে। সঙ্গে বড়ি দেওয়া লাল শাক ভাজা। দোকানি লোকটা সামনে এসে বলে , ' এখানে সবাই খালি ভাত, ডাল আর মাছের ঝোল খেতে আসে। তাই কিছু না পেয়ে মাছের মাথাটা ভেজে দিলাম , সঙ্গে শাক ভাজাটা। খেয়ে দেখুন ভালো লাগে কি না। দেখি নীলু এক বিশাল তৃপ্তি নিয়ে মাছের মাথা খুলে খুলে খাচ্ছে। খাওয়াটা সেদিন ক্ষিদের মুখে ভালোই লেগেছিলো। দোকান থেকে বেরোচ্ছি , দোকানি জিজ্ঞেস করলো , ' কেমন লাগলো। ' আমি বলি , ' খেয়ে বেশ আনন্দ পেলাম। ' দোকানি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয় , ' আপনাদের আনন্দেই আমার সুখ। ' রাস্তায় নেমে নীলু বলে, ' এবার বুঝতে পারলেতো আনন্দ আর সুখের ফারাক। ' আমি বলি , ' তুই কি বুঝলি সেটা আগে বল। ' নীলু বেশ বিজ্ঞের মতন বলে , ' ইচ্ছে করলেই আনন্দ উপভোগ করা যায়। জমে থাকা আনন্দ সুখ ডেকে আনে। চলো আমরা আপাতত কয়েক বছর আনন্দ উপভোগ করি। সুখের সন্ধান পরে করলেও হবে। '
______________________
© সনৎ মিশ্র
No comments:
Post a Comment