Sunday, 26 February 2017

।। ছেঁড়া কবিতা ।।



এখন আমি আর কবিতা লিখিনা জানো
আমি শুধুই ভালবাসি
যেদিন কৈশোরে তোমারে দেখেছিলুম
বড় রাস্তার বাঁকে, সেদিন এক খাতা কবিতা এঁকেছিলুম
তারপর থেকে শুধুই ভালবাসি
কতো...বার বলতে গিয়ে বলা হয়ে ওঠেনি
আমি, আমি, আমি শুধুই ভালবাসি
তরতর করে বেয়ে উঠলাম যৌবনে, মনের ডালে ডালে
লেখা, ভালবাসি ভালবাসি আর ভালবাসি
তুমিও তখন সদ্য যুবতী, শরীরে ঐশ্বরিক শিল্পের ছোঁয়া
এদিকে কঙ্কালসার আমি শুধুই ভালবাসি
পরীক্ষার খাতা জুড়ে অজস্র দুর্বোধ্য আঁকিবুঁকি
তাতে লেখা তোমার নাম, আর শুধুই ভালবাসি
সেই ঝড়ের সন্ধ্যায়, যখন তুমি উদভ্রান্ত, দাঁড়ালে সমুখে
নিকষ আঁধার চিৎকার করে শুধালো - ভালবাসি?
আমি নিরুত্তর, তুমি নিশ্চুপ, আকাশে চকিত বিদ্যুৎপ্রভ
তোমার চোখের তারায় লেখা ভালবাসি ভালবাসি
তারপর তুমি হারালে, সেই নিকষ আঁধারের অন্তরালে
আমি উন্মাদ, উদভ্রান্ত আজ, হারিয়ে খুঁজতে "ভালবাসি"
বড় রাস্তার বাঁক হয়ে কবিতার খাতা, পরীক্ষার কক্ষ
সব হারালো সেই নিকষে, আঁধারিয়া অভিযাত্রী আজও -

ভালবাসি
___________________
©উন্মাদ হার্মাদ

Sunday, 19 February 2017

।। এক জীবনে ।।



 আমার ঠাকুর্দা অবিভক্ত বাংলার বরিশাল শহরে জিলা স্কুলে প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বাবাও একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে সেই সময়ের শিক্ষার গুনে বা দোষে একই সঙ্গে অংক ও সংস্কৃতের শিক্ষক ছিলেন। পরিবারটির বিত্ত ছিল না বিদ্যা ছিল। ’আগে জান পরে ধান’ কিংবা ‘বিষয় আষয় হগলি থুইয়া ল পালাইয়া ইন্ডিয়া’ স্বার্থাণ্বেষী মহলের এইসব বিভ্রান্তিকর রটনায় ১৯৫১ সালে ভিটামাটি ছেড়ে লক্ষলক্ষ শরণার্থী  পশ্চিমবাংলায় প্রবেশ করেন। এক প্রতারক দালালের হাতে পড়ে একমাত্র স্থাবর সম্পত্তি বরিশাল শহরে দশ কাঠার উপর ভিটেবাড়ি এই বিষয়আষয়ে অনভিজ্ঞ বিদ্যা সর্বস্ব পরিবারটির হাতছাড়া হয়।
 নিঃসম্বল অবস্থায় ঐ বছর মার্চে সীমান্ত পেরিয়ে নানা ঘাটে ভীড়তে ভীড়তে আমার পরিবারটি  ঠাকুরদার এক প্রাক্তন ছাত্রের সহৃদয়তায় ১৯৫৩ সালের জানুয়ারিতে  ব্যারাকপুর গঙ্গা পারে গড়ে ওঠা হরিহর উদ্বাস্তু কলোনীতে রাস্তাসংলগ্ন একটি চারকাঠা প্লটের দখল পায়।
 দেশবিভাগের তীব্র দহনজ্বালা অর্ধাহার এবং তৎকালীন কলোনী জীবনের গ্লানি ও সংগ্রাম সহ্য করতে না পেরে ১৯৫৩র নভেম্বরে আমার ঠাকুরদা মারা যান। তার আগে ঐ কলোনীতেই  হরিহর উদ্বাস্তু আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে যান। এই বিদ্যালয়েই আমার বাবা এরপরে একটানা বছর সতের শিক্ষকতা করেন।  ১৯৫৩ সালে আমাদের পরিবারে মৃত্যু ওইখানেই থেমে থাকে নি। ঠাকুরদার মৃত্যুর দশদিন পরে আমার একমাত্র কাকাটিও তিনদিনের এক অজানা জ্বরে মারা যান এবং এই পরিবারটিতে ১৯৫৩ র ২৭এ ডিসেম্বর একটি যুগপত্ জন্ম ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। আমার সর্বংসহা জননী তাঁর একমাত্র সন্তানের জন্মের সময়ের ধকল এবং অতিরিক্ত উচ্চ রক্তচাপজনিত কারণে বাড়িতেই সন্তান প্রসবের কয়েক ঘণ্টা পর  রক্তের স্রোতে ভেসে গিয়ে সব সহ্যসীমাই অতিক্রম করেন এবং ভালো করে সাধের সন্তানের মুখ দেখার আগেই চলে যান। জন্মদুঃখী আমি অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়ায় আমার নাম রাখা হয় জীবন -জীবনরতন বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে ঠিক অলৌকিক ভাবে নয় জ্নমের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমার জীবনে আবির্ভাব হয় এক গৃহী বেশ্যার যার কিছু মামুলি কেচ্ছাই এই লেখাটির মূল স্রোতস্বিণী।
আমার পাশের বাড়ির রাণী কাকিমার বিতর্কিত(অবৈধও পড়তে পারেন)সন্তানটি আমার জন্মের দুদিন আগে জন্মগ্রহন করে এবং খুব ছেলেবেলায় বোকাসোকা ছিল জন্য তার ডাক নাম রাখা হয় বুকু। এই বুকুর মাতৃস্তন্যের আমি ভাগীদার হয়ে পড়ি। রাণী কাকিমা বুকুর মুখে একটি স্তন্য ও আমার মুখে একটি স্তন্য গুঁজে দেন। এ আমার ও বুকুর প্রায় দু বছর বয়স পর্যন্তই চলে।
 রাণী কাকিমার স্বামী বঙ্কিম সান্যাল আসামে একটি চা বাগানের কর্মচারী ছিলেন, সেখানে তার খাসিয়া পত্নীর গর্ভে দুটি সন্তান থাকা সত্বেও এই সৎ ব্রাহ্মনটি একটি খাটি ব্রাহ্মন কন্যার গর্ভে খাটি ব্রাহ্মণ সন্তানের পিতা হওয়ার লোভে আগের বিবাহাদির কথা পুরোপুরি গোপন করে কপর্দকশূন্য পরিবারের মেয়ে রাণী গাঙ্গুলীকে বিয়ে করেন এবং এই সময়ই বিটিরোডের উপর একটি চা মিষ্টি সিঙাড়ার দোকান চালু করেন যাতে আর খাসিয়া বৌসন্তানদের কাছে না ফিরতে হয়। কিন্তু  বাতাসে ভেসে কাকিমার কানে আসে স্বামীর নষ্টামি ভ্রষ্টাচারের খবর। প্রবল তেজস্বীনী কাকিমা যখন ঝগড়া থেকে সদ্য বিবাহিত স্বামীর সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন সান্যাল মশাই তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে সর্বসমক্ষে পরিত্যক্ত ঘোষনা করে প্রথম স্ত্রীর সাজানো সংসারে ফিরে যান।
এইসময়ই কাকীমার নিজের মাসতুতো দাদা খগেন চক্রবর্তী মালদা থেকে কাকীমার কাছে আসেন আশ্রয়ের খোঁজে। স্রোতে ভাসতে থাকা কাকীমা তাঁর এই দাদাটিকে খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরেন।
 খগেন ছিল অতি খলিফা ব্যক্তি।  মাসতুতো বোনের কাছ থেকে শুধু চায়ের দোকানের অধিকার না তাঁর শরীরেরও উপর অধিকার কায়েম করে। স্বামীর ত্যাজ্য হওয়া  এবং খগেনের আবির্ভাব একই সময়ে ঘটে এবং এর ঠিক এক বছরের মাথায় আমি যার প্রাপ্য স্তন্যের ভাগীদার হই সেই বুকু কাকীমার কোলে আসে।
তৎকালীন প্রবল প্রতাপান্বিত কলোনী কমিটি যখন কাকীমাকে ডেকে পাঠায় তখন জেরার মুখে তিনি বলেন আসামে ফিরে যাওয়ার মাসখানেক বাদে একদিন গভীর রাতে বঙ্কিম সান্যাল খাসিয়া বৌকে খুন করে পুলিসের ভয়ে পালিয়ে এসে প্রথমে কাকুতিমিনতি পরে ছোরা দেখিয়ে তিন রাতের জন্য আশ্রয় নেয় এবং পুলিসের ভয়ে অন্ধকারেই পালিয়ে যায়। কাকিমার বয়ান অনুযায়ী বুকু বঙ্কিমের ঔরসজাত সন্তান।
এই গল্প অতি নাটকীয় বলে কলোনী কমিটি বাতিল করে এবং  প্রায় প্রকাশ্যেই বুকু তার মামা খগেনের সন্তান বলে চিহ্নিত হয়।  বুকুর জন্মের পরপরই মিষ্টির দোকানের দখল পুরোপুরি হাতে আসার পর খগেন পাশের গান্ধীকলোনীর  মা বাবার একমাত্র সন্তান একটি মেয়েকে বিয়ে করে ও শ্বশুরবাড়িতেই থিতু হয়।
ব্রাহ্মনকন্যা রাণী কাকীমা বাঁচার তাগিদে বাড়িবাড়ি ঠিকে ঝিয়ের কাজ নেন। কিন্তু তৎকালীন কলোনীর লোকেদের ঠিকা ঝি পোষা বিলাসিতারই নামান্তর । মাসের শেষে বাড়িপ্রতি ৫টাকা , ৭টাকা  ১০টাকা নিয়মিত মায়না আদায় করা এক বিড়ম্বনাই ছিল কাকীমার পক্ষে। একটা সন্তানকে বড় করা নিজের ভাতকাপড়। সন্তানের ক্ষুধার্ত চীৎকার নিজের ক্ষুধার কামড়ের থেকেও মর্মান্তিক। পরণের বস্ত্র শতচ্ছিন্ন হয়ে এমনিই লজ্জা ঢাকতে পারছিল না। কাকীমা মাসে একআধ সন্ধ্যা বিটি রোডের আলোআঁধারিতে গিয়ে দাঁড়াতেন,নিজের ও সন্তানেরপেটের ভাত জোগাড় করতেন খরিদ্দার বাড়িতে বসিয়ে। রাণী কাকীমার নাম চালু হয়ে যায় খানকি রাণী বলে। আরো শিক্ষিত রসিক লোকের  মুখে গৃহীবেশ্যা।
             ১৯৭০ সালটি আমার জীবনের একটি মোচড়। ঐবছর আমার হায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষার ফিজিক্স প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার আগের দিন আমার বাবা স্কুলেই ক্লাস নিতে নিতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এবং আমি গুরুদশা অবস্থায় পরীক্ষা শেষ করে আমার বাপ ঠাকুরদার 'হরিহর উদ্বাস্তু আদর্শ বিদ্যালয়ের ' থেকে হায়ার সেকেণ্ডারিতে সপ্তমস্থান অধিকার করি।
সেইসময় ছোটখাট স্কুলগুলোর শিক্ষকদের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল ভয়াবহ বিশেষ করে আমার বাবার মত যারা নীতিগতভাবে প্রাইভেট টিউশান দিতেন না। ফলে পারিবারিক সূত্রে মেধা, সুপুরুষচেহারা এবং কলোনীতে গঙ্গাপারে রাস্তা সংলগ্নচারকাঠা জমির উপর একটি বেড়া ও টালির ঘর এই নিয়ে গুরুদশা কাটতে না কাটতেই রাস্তায় দাঁড়ানোর পরিবর্তে প্রাইভেট টিউশান পড়ানো শুরু করি। রেজাল্ট বেরোতে আমার বাবার স্বপ্ন সার্থক করতে এই টিউশানের ভরসাতেই  প্রেসিডেন্সি কলেজে ফিজিকসে অনার্স নিয়ে ভর্তি হই।
১৯৭০ সালের প্রেসিডেন্সি নকশাল আন্দোলনের প্রসব গৃহ। পিছুটানহীন সহায়সম্বলহীন আমার এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না।আমি অন্তরালে চলে যাইএবং পার্টির নির্দেশে উত্তর কোলকাতা ও বেলঘরিয়া অঞ্চলের অ্যাকশান স্কোয়াডের সদস্য হই।
এইসময় ১৯৭১ এর বসন্তে একদিন সোদপুর লেবেল ক্রসিংএ পুলিস ও সিআরপিরযৌথ বাহিনীর সঙ্গে গুলি বিনিময়ে ক্রমশঃ পিছু হটতে হটতে প্রাণ বাঁচাতে পিস্তল সহ আমার বাড়িতে ঢুকে পড়ি এবং ভূল করেছি বুঝতে পেরে মেঝেতে পাতা কাচা ইট সরিয়ে দরমার বেড়ার তলা দিয়ে শুয়েশুয়ে বেরিয়ে বাড়ির পিছনে রাণী কাকীমাদের কুয়োতলার পাশেই টিন দিয়ে ঘেরা গলা সমান উচু ছাদহীন চানঘরে পালাতে যাই। রাণী কাকীমা ভিতরে স্নান করছিলেন। শব্দ পেয়ে দরজা সামান্য ফাঁক করে আমাকে উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় দেখে এই প্রখর বুদ্ধিমতী মহিলা আমার প্রাণশংসয় বুঝে গেলেন এবং হাত ধরে টেনে আমায় ভিতরে ঢুকিয়ে কোনোমতে  গামছা জড়িয়ে গামলা তার উপর বালতি তার উপর আবার বালতি চড়িয়ে আমায় তার আড়ালে লুকিয়ে ফেললেন। বাইরে তখন পুলিস সিআরপি পৌঁছে গেছে। কাকীমা বুটের আওয়াজ পেয়েই গলা বারিয়ে চীৎকার করে উঠলেন,“কে কে? বাড়িতে আমি একা। চান সারি। পুলিশের আইজকাইল ন্যাংঠা মাইয়াছেলের নাওন দেহনের কাম পড়ে না কি? ভালোয় ভালোয় যান সব। নয়লে আমি কিন্তু সরকারে জবরদস্তি আমার নাওনের সময় ছানঘরে জবরদস্তি ঢোকনের নালিশ দিমু। “ লোকাল থানার ওসি খানিকক্ষন স্তব্ধ হয়ে থেকে দলবল নিয়ে ফিরে গেলেন। আমার স্তন্যদায়িনী দ্বিতীয় মা আমার প্রাণ বাঁচালেন।      
 ১৯৭২ এর শেষের দিকে নকশাল আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে গেলে আমি ১৯৭৩ এর গোড়ায় মূলস্রোতে ফিরে আসি,নতুন করে জয়পুরিয়া কলেজ থেকে পরীক্ষা দেই এবং ফার্স্ট ক্লাসও পাই। এম এস সিতে স্ট্যান্ড করার পর অ্যামেরিকায় বার্কলেতে ডক্টরেটের স্কলারশিপ পেতে কোনো অসুবিধা হয় নি।১৯৭৮এ দেশ ছাড়ার আগে আমার চারকাঠা বর্গাকার জমিটির দলিল রাণী কাকীমার হেফাজতে রেখে আসি।
দেশ ছাড়ার কিছু  আগের থেকেই আমি কলোনীগুলোর বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীন কিছু পরিবর্তন নজর করি। অধিকাংশ লোকের সৎ অসৎ নানা ভাবেই রোজগারের রাস্তা খুলে যায়। অজস্র  পাকাবাড়ি উঠতে থাকে রাস্তাঘাট ভালো হয়,পানীয় জলও তূলনামূলকভাবে সহজ লভ্য হয়। আমার ঠাকুরদা প্রতিষ্ঠিত  আদর্শ বিদ্যালয়টি জেলার অন্যতম নামী বিদ্যালয় হয়ে ওঠে।
 অন্যদিকে 'রাজনৈতিক শক্তিই প্রধান শক্তি' এই চেতনায় প্রলুব্ধ হয়ে মানুষে মানুষে সৌহার্দ ভালোবাসা স্নেহ শ্রদ্ধা নষ্ট হয়।  রাণী কাকীমার পেটের ছেলে বুকুর মধ্যেও পরিবর্তন দেখতে পাই। সে আর বোকাসোকা ছিল না।সোদপুর বাজারে সেএকটি  মাংসের দোকানের মালিক হয়।  ক্রমশঃ ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে গুণ্ডা হিসাবে তার কুখ্যাতি ছড়াতে থাকে।                                

আমি ডঃ জীবনরতন বন্দ্যোপাধ্যায় অালট্রা ইয়োলো
 রে র জনক।   কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সময় আমার জীবনের একমেবিদ্বিতীয়ম প্রেমটি আসে ১৯৮৫সালে। ক্রিয়েটিভ আর্ট বিভাগের রিসার্চ স্কলার একটি মেয়ে অ্যানিটা মিটার যার পূর্ব পুরুষ হুগলী জেলা থেকে১০০বছর আগে অ্যামেরিকায় সেটল করে সে বোধহয় আমার সুপুরষ চেহারা দেখেএবং মেধার গল্প শুনে( আলট্রা ইয়োলো রে আবিষ্কারের সঙ্গেসঙ্গে আমার নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং আমি প্রথম শ্রেণীর আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীর স্বীকৃতি পাই)আমার প্রেমে পড়েন। দু বছর রোমান্সের পর আমরা ১৯৮৫র মার্চে বিয়ে করি।
 বিবাহোত্তর শয্যামিলনের নিশ্চয়তার প্রশ্রয়ে রোমান্স মরে যায় । হয়তো পারস্পরিক নির্ভরতা মমত্ব স্নেহ বাড়ে। আমাদের ক্ষেত্রে কয়েক মাসেই রোমান্স মরে যায় কিন্তু তেমনভাবে স্বামী স্ত্রী সম্পর্কের রসায়ন পুষ্ট হয় নি।অ্যানিটা নেশাদার এবং পেশাদার অঙ্কনশিল্পী। নগ্ন  পুরুষমানুষের ছবি আঁকে। বহু অ্যামেরিকান পুরুষমেয়েই একগামী।কিন্তু পাবলো পিকাসো যেমন সাধারণতঃ তাঁর সুন্দরী ন্যুড মডেলদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন  না করলে সার্থক সৃষ্টি করতে পারতেন না অ্যানিটারও তাঁর হ্যান্ডসাম পুরুষ মডেলদের যৌন উপভোগের নেশা ছিল। শরীর নিয়ে তাঁর কোনো যেমন ছুৎমার্গ ছিল না  এসবকে সে পাপও মনে করত না। তখনই সে যথেষ্ট নামী অঙ্কনশিল্পী এবং প্রকাশ্যেই বলতো যে কোনো নারীর চরিত্রের বাসস্থান  তাঁর যোনিদ্বার নয়।  শিল্প সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখতে সে সন্তানের মা ও হয় নি। অথচ বিরাট মনের অধিকারী এই ভদ্রমহিলা নিজের আয় এবং পারিবারিক আয়ের মোটা অংশই দূস্থ  শিল্পীদের পিছনে ব্যয় করে। মানুষের দুঃখে হাউহাউ করে কাঁদে ক্যানসারে আক্রান্ত শিশুদের পিছনে লাখলাখ টাকা খরচ করে।অন্যদিকে আমিও গুছিয়ে সংসার করা আজন্ম দেখি নি এবং করার জন্য বোধহয় জন্মাই ও নি।
 ফিজিকস , সুপারফিজিকস ই আমার আসল ভালোবাসা। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা  ও সুসম্পর্ক বজায় রেখেই আমরা১৯৯৫র জুলাইতে দুজন দুজনকে মুক্তি  দিলাম।
  এরপর জন্মদুঃখী নিঃসঙ্গ অবহনযোগ্য আমি পাঁচ বছর গবেষণা ও অধ্যাপনায় ডুবে থাকার পর প্রায় ২২বছর পর নিজের হরিহর কলোনীর চারকাঠার বর্গাকার সেই জন্মভিটায় ফেরার আকুতি অনুভব করলাম। কেউই নেই সেখানে পিছন ফিরে দেখার যদি জীবনদায়ীনী  রানী কাকিমা বেঁচে থাকেন এই আশায় তাঁর ঠিকানায় একটা আন্তর্জাতিক টেলিগ্রাম পাঠালাম।            
এয়ারপোর্টের খুব কাছেই হরিহর কলোনীতে পৌঁছানো কোনো সমস্যা ছিল না। তারপরই সব কেমন গুলিয়ে গেল। গঙ্গাসংলগ্ন একদা  উদ্বাস্তুু কলোনী এখন হরিহরনগর। বড়বড় বহুতল শোভিত এলাকার অধিবাসীরা আমায় চিনবে না জানতাম। জিজ্ঞাসা করে আদর্শ বিদ্যালয় খুঁজে বার করে একটি মুদিখানা দোকানে ‘বোকাদের বাড়ি কোনটা?’ জিজ্ঞাসা করায় বিরাট ধমক খেলাম। ‘বোকা কি মশাই?আপনার জন্য আমরা মার খাব নাকি?ওনার ভালোনাম বিক্রম সান্যাল। এই বেলঘরিয়া সোদপুর ব্যারাকপুর এলাকার সবচেয়ে বড় প্রোমোটার। দাপটে বাঘেগরুতে মানে দুটো প্রধান  রাজনৈতিক দল একই বোতলের স্কচ খায়।’  
বুকু  যখন ছেলেবেলায় মায়ের স্বামীর  উপাধি ব্যবহার করতো নিষ্ঠুর লোকজন বলত,‘আচ্ছা বোকা নয় বিরিকরমই হইল। তয় সান্যাল?আরে খগেন চক্বোত্তীর পোলা তুই বিরিকরম চক্কোত্তী। ’বোকাসোকা বুক্কু না বুঝে হি হি করে হাসত। এখন নিজের অর্থবলে বাহুবলে বিক্রম সান্যাল হয়েছে সব নোংরা বিরূপতাকে দমন করে।  
                 পাশাপাশি দুটো প্লট যেমন ১৯৭৮ সালে ছিল প্রায় তেমনই আছে। আমাদের বেড়ার বাড়িটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে । কাকীমার কাছেই উঠলাম।২২বছর পরেও কাকীমা সবই মনে রেখেছেন। আমার জন্য আমার প্রিয় ফুলকপি কইমাছ আর পায়েস করে রেখেছিলেন এই ৭২ বছরের অশক্ত  শরীরের বৃদ্ধা। খেয়ে উঠে জেটল্যাগে ঘুমে চোখ ভেঙে আসছে।   কাকীমা খাটে পাশে এসে বসলেন, কপালে হাত বুলাতে বুলাতে বোললেন,“মন! ত’র লগে কয়খান কথা আছে। বুকুর থাবার চেয়ে অনেক কষ্টে বাঁচাইয়া রাখছি এই ল ত’র দলিল। আর আমার খানও রাখ। ত’র দুইপাশে দুইখান প্লট কম পয়সায় ভয় দেখাইয়া কিনছে। ত’র ওই চৌকা জমিটার উপরে ওর  নোলা ।তার সঙ্গে অনেক দুঃখের আমারটার ও। ত’র দলিলখান সামনের ঐ ব্যাঙ্কে কিছু টাকা দিয়া একখান ঐ লকার না কি কয় ভাড়া লইয়া ওইখানেই রাখ। এই দুই দলিলের জন্য তিনবার আমার পেটের পোলা আমার গলা টিপ্পা মারতে গেছে। তুই দেওয়াল দিয়া খানদুই ঘর অন্তত কইরা রাইখ্যা যা। আর ঐ পাপরে এই আমার এই জমিও দিম না। ওর হাতে তিন মানুষ মারনের রক্তলাগা। নিজের নামে দুই বউ এর নামে দশদশ খান ফেলাট পাঁচখান বড় গাড়ি আছে। তুই থাকতে থাকতে বন্দোবস্ত কর। আমি এইখানে অনাথ আশ্রম খুলুম। ”    
                  ভেবেছিলাম  আর অ্যামেরিকা ফিরে যাবো না। কিন্তু  তা হয় নি। এখানে আমার স্তন্যদাত্রী জীবন দাত্রী মা আছেন যার কথা২২ বছরে মনে পড়ে নি ।ওখানে কেউই নেই। তবুও কর্ণেলে পদত্যাগ পত্র পাঠাতে পারি নি। কারণ সেই ফিজিক্স অর্থাত্  সুপার ফিজিক্সের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ। ফিজিক্স চর্চা ছাড়া আমার বেঁচে থাকার  আর তেমন কোন আকর্ষণও এযাবত্ ছিল না । এবারে আরো একটা আকর্ষণের ক্ষেত্র তৈরী হলো।আমার প্লট কাকিমার প্লট মিলিয়ে আমারই অর্থে কাকিমার নামে অনাথ আশ্রম তৈরি করেছি “রাণীমার রাজপুত্র রাজকন্যারা। ”
যতদিন কাকীমা বাঁচবেন বছরে একবার করে ছুটি নিযে এসে তাঁরই সাথে আশ্রমের এককোনে পড়ে থাকব। তারপর আবার অ্যামেরিকা কর্মস্থলে ফিরেও যাবো  সুপারফিজিক্স চর্চার টানে।
ঈশ্বরে সে ভাবে বিশ্বাস করতে পারি না কিন্তু এই অনাথ আশ্রমই হবে এখন থেকে আমার বাত্সরিক তীর্থস্থান। যতদিন রাণীমা বেঁচে থাকবেন আসবো  তারপরও আমৃত্যু আসব তাঁর রাজপুত্র রাজকন্যাদের দেখাশুনো করতে। রাণীমার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে।

 আমার প্রাক্তন স্ত্রী অ্যানি বলতো কিন্তু তাঁর আচরণের থেকেও অনেক বেশী শিখলাম রানীমার জীবনচর্য্যা থেকে- নারীর চরিত্র তাঁর যৌনজীবনে নয় তাঁর ভিতরের মনুষ্যত্বের শক্তিতে।

( সব চরিত্র কাল্পনিক। )
___________________________
© পৃথ্বী ব্যানার্জী

।। কবির গুঁতো ।।



ঠিক দুপ্পুর বেলা, কবি মারে ঢেলা
সে এক আজব ধাঁধাঁর খেলা
শুঁটকো কবি, মুটকো কবি
ভাবুক কবি, অবাক কবি
সবাই মিলে করছে সেথায় গুলতানি
পান্ডা কবি চেঁচিয়ে বলে
আয় না এবার এক এক করে
শুনবো তোরা লিখলি কেমন
দেখবো তোদের মাস্তানি
শুরু হলো হাত পা ছোঁড়া
কেউ কবিতা কেউ বা ছড়া
আজব ধাঁধা কোনো মানে নেই
কতক শ্রোতা ছিলো ঘাপটি মেরে
সজাগ হলো মুন্ডু নেড়ে
এক ছুটেতে পালায় তারা
সুযোগ পেল যেই
পান্ডা কবি উঠলো বলে
ধর ধর ধর পালায় যেরে
জানেনা কি করছি মোরা কাব‍্য
নিয়ায় ওদের ঘাড়টি ধরে
বসা এবার চুপটি করে
বুঝবে ওরা হাড়ে হাড়ে
কবিরা সব কেমন তরো দ্রব্য।
_________________________
© কুনাল ভট্টাচার্য্য

Tuesday, 14 February 2017

।। ভালোবাসার সাত সতেরো ।।


(১)
স্টেশনে আজ খুব ভিড়।শুধু স্টেশন কেন আজ পার্কে,মাঠে,রেস্তোরায়,ক্যাফেতে এমনকি গাছের আড়ালেও খুব ভিড়।আজ ভ্যালেন্টাইনস ডে।রবি বিরক্ত হয়ে ভুরু কুঁচকে দেখছিল সমবেত প্রেম পিপাসুদের।বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ উৎসবের আবহাওয়া।ক্লাস জমেনি তেমন।এখন রবি ফিরছে,স্টেশনে এসেও দেখছে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আত্মা তার পিছু ছাড়ে নি।আচ্ছা,ভালোবাসাকে কি ঘন্টা মিনিটের বন্ধনে আবদ্ধ করা যায়?উদযাপন করা যায় ভালোবাসার সাত রংকে একদিনের উন্মাদনায়?তাহলে সব লোক কেন এই সমবেত পাগলামিতে অংশগ্রহণ করছে সানন্দে?রবি আনমনা হয়ে ভাবতে ভাবতে আকাশের দিকে তাকাল।কনে দেখা আলোয় ভরে গেছে চারিদিক।অনেকদিন পর এমন হলুদ আলোর বর্ণচ্ছটা আকাশ জুড়ে।কুঁচকানো ভুরু আপনাআপনি সোজা হয়ে যাচ্ছিল রবির,ঠোঁটের রেখা বক্রতা পাচ্ছিল একটু একটু করে।এমন সময় চোখ পড়ল নাড়ুদার চায়ের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার উপর।মেয়েটা একা দাঁড়িয়ে,পরণে সাধারণ সালোয়ার কামিজ,চুল গুলো হালকা ভাবে মুখের উপর ছড়িয়ে পড়েছে।বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে নাকের ডগার উপর।নামেই ফেব্রুয়ারি মাস, গরম বেশ।একটি সাধারণ মুখ,কিন্তু আজকের হলুদ বিকালের মাদকতাময় কনে খোঁজা আলো মেয়েটির মুখের উপর বুলিয়ে গেছে এক অপার্থিব সৌন্দর্যের জাদুতুলি।
ভিতরে ভিতরে একটা অচেনা আবেগে ভরে উঠছিল রবি।এটা কি হচ্ছে?ওই অচেনা মেয়েটাকে কেন এত ভালো লাগছে?একটা অসহ্য ভালোলাগা দমবন্ধ করে দিচ্ছে তার।কে মেয়েটা?
ট্রেন এসে দাঁড়াল প্ল্যাটফর্মে।রবির পা উঠল না।মেয়েটি ট্রেনের ভিড়ে মিলিয়ে গেল।স্টেশনের ৩ নং প্ল্যাটফর্মে বিকেল পাঁচটা বেজে তিন মিনিটে রবি বুঝল প্রেমের প্রথম মানে।অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করল রবি,"হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনস ডে।"

(২)
প্রিয়া মার্কেটের ৫ নং স্টলে এসেছে এক গোছা লাল টকটকে গোলাপ কেনার উদ্দেশ্যে।পুরো দোকানটাই আজ লাল রঙে সেজেছে।থরে থরে লাল গোলাপ রাখা।দোকানে ভিড়ও খুব।তার মধ্যেই নিজের চাহিদার কথা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল প্রিয়া।এক গোছা লাল গোলাপ দিয়ে একটা তোড়া বেঁধে দিতে হবে তাকে,তার অনিন্দ্যর জন্য।দোকানদার যখন গোলাপ সাজাচ্ছে বোকেতে তখন প্রিয়ার চোখ ঘুরছিল দোকানে সাজিয়ে রাখা ছোট্ট ছোট্ট ভালোবাসার কুঁড়ি গুলোর উপর। হঠাৎ দোকানের কোণে একটা ঝুড়িতে রাখা কিছু অবহেলিত সাদা গোলাপের উপর তার চোখ পড়ল।প্রিয়া বলে উঠল,"আর ওই সাদা গোলাপের ও একটা বোকে দেবেন।"
একটু পর যখন প্রিয়া বেরিয়ে এল দোকান থেকে তখন তার দুহাতে লাল সাদা রং হাসছে।আজ অনির ভালোবাসার রঙে মায়ের স্নেহের রং ও মিশে যাবে এমনভাবে প্রিয়া একটু আগেও ভাবতে পারেনি।আজ তার দুজন ভ্যালেন্টাইন।মায়ের মুখের অবাক হাসিটা কত মধুর হবে ভেবে আনন্দে চোখে জল এসে গেল তার।আকাশে মুখ তুলে প্রিয়া সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে ধন্যবাদ দিল,"হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে মা।"

(৩)
সমীর আজ ছটা একুশের লোকালটা মিস করল একটুর জন্য।যাহ, অনেকটা দেরি হয়ে যাবে আজ।প্রেসেন্টেশনটা খুব ভালো হয়নি আজ।বসের কাছে কথা শুনতে হয়েছে।তার উপর ট্রেন মিস।আজ রোমিতা কথা শোনাবে।রোমিতার মাসির মেয়ের বিয়ে আজ।পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে।বেজার মুখে স্টেশনের গেটের পাশে রাখা ঠেলাগাড়িটার দিকে তাকাল সে,ভ্রাম্যমান ভ্যালেন্টাইন গিফট এর পসরা।কি ভেবে সেদিকে এগিয়ে গেল সমীর।পাঁচ বছরের একসাথে থাকাটা বড্ড রোজকার ডালভাত হয়ে গেছে।আজ রাতে শোয়ার সময় একটা লাল গোলাপ যখন রোমিতা নিজের বালিশের উপর দেখবে ,তখন এক মুহূর্তের জন্যও কি সেই ফুলশয‍্যার রাতের সলজ্জ অনুরাগের প্রতিচ্ছবি তার মুখে ফুটে উঠবে না!
তখন না হয় সমীর গাঢ়স্বরে রোমিতার কানে কানে বলবে,"হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনস ডে।"

(৪)
আজ রায়বাড়িতে রীতিমত হৈচৈ লেগেছে।ছেলে মেয়ে সবার ঘরের নাতি নাতনিরা আজ দাদু বাড়িতে জমায়েত করেছে।তারা আজ তাদের গ্র্যান্ড পেরেন্টদের ভালোবাসা সেলিব্রেট করতে চায়।এমনিতে ফাঁকা পড়ে থাকা নিঝুম পুরী আজ কোন জাদুবলে সঞ্জীবিত হয়ে উঠেছে রাজপুত্তুর রাজকন্যাদের কলকাকলিতে।রায়বাবুও নাটিনাত্নীদের ছেলেমানুষিতে সমান অংশীদার।ঠিক  বিকেলে গোধূলি লগ্নে তাদের বিয়ে হয়েছিল তাই সেই সময়টাই উৎসবের সময় হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে।শাড়ি গয়নায় সাজিয়ে রায়গিন্নিকে নিয়ে আসা হল আসরে।ধুতি চাদরে শোভিত রায়বাবু হাঁটু গেড়ে বসে গিন্নিকে প্রপোজ করলেন।রায়গিন্নি হেসে চোখ উল্টে মুখ ঝামটে বলে উঠলেন,"মরণ!"
নাতি নাত্নীররা হৈ হৈ করে হল্লা শুরু করল।সবার মাঝে দুই গোধূলির চোখ মিলল।পঞ্চাশটা বছর কেটে গেছে একসাথে,তারা একে অন্যের ভ্যালেন্টাইন।ভালোবাসা দিনের অপেক্ষা করে না তারা জানেন।আজ সেন্ট ভ্যালেন্টাইন তাদের এই ছোট ছোট ভ্যালেন্টাইনদের সাথে দিন কাটানোর সুযোগ করে দিয়েছেন।বুড়ো বুড়ি মহা খুশি আজ।তারাও নাতি নাতনিদের সাথে গলা মিলিয়ে বলে ওঠেন ফুর্তিতে,"উইশ ইউ অল হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনস ডে।।"
_____________________________
© সুদীপা কুন্ডু

।। ভ্যালেন্টিন ডে ।।

(১)

----পরানদা ও পরানদা--- শোনো--বিকেলে একটু সাড়ে পাঁচটা নাগাদ তোমার রিক্সাটা চাই।
----আচ্চা দীপদাদা তুমার গরে টিক পাঁচডার সময় পইচে যাবো।
----না না, ঘরে এসো না। আমি এই মোড়ের মাথাতেই দাঁড়াবো। তুমি থেকো।
----আচ্চা তাই হবে গো
----আর শোনো, ওই প্লাস্টিকের ঢাকনাটা রেখো কিন্তু যেটা বর্ষায় লাগাও।
----এঁজ্ঞে, রাকবো গো
       ঠিক পাঁচটার মধ্যে পরান রিক্সা নিয়ে হাজির হয়ে গেল পাড়ার মোড়ে। দীপদাদাটা অনেক সময়ই তাকে সাহায্য করে টাকা পয়সা ধার দিয়ে। তাই ওর কথা কাটতে পারেনা পরান। পৌনে ছটা নাগাদ  দীপ এল।
----শোনো পরানদা এমন কোন রাস্তা আছে যেখানে লোকজন একটু কম থাকে, মানে সন্ধ্যের দিকটা একটু ফাঁকা ফাঁকা থাকে আর কি; জানো?
---এঁজ্ঞে দীপদাদা ওই ডাগদারদের পাড়াডার পেচন দিগটা সনদেবেলা এগদম ফাঁকা থাকে গো
----বা বা, বেশ বেশ, ওদিকটাতেই চলো। শোনো তার আগে আরেকজনকে তুলব চলো।
পরান রিক্সা ছোটালো। দুটো পাড়া পরেই রাস্তার ওপর দাঁড়িয়েছিলো স্নিগ্ধা। তাকে দেখেই দীপ বলল,----পরানদা দাঁড়াও।
হাতের ইশারায় স্নিগ্ধাকে ডেকে রিক্সায় উঠিয়ে নিল দীপ। পরান আবার রিক্সা ছোটালো।
         সন্ধ্যে হয়ে গেছে। ডক্টরস কলোনিটা ফাঁকা থাকে বলেছিল বটে পরান কিন্তু এতটা ফাঁকা হবে দীপ ভাবতে পারেনি। হালকা শীতের আমেজ এখনো রয়েছে। তাই প্রতিটা বাড়িরই দরজা জানালা সব বন্ধ। দেখে খুব খুশি হয়ে গেল দীপ। বাহ্! মোক্ষম জায়গা বাতলেছে পরানটা! রিক্সাটা ধীরে চালাতে বলে প্লাস্টিকের ঝাঁপটা নামিয়ে দিল দীপ। জামার ভেতর থেকে একটা লাল গোলাপ বের করে স্নিগ্ধাকে দিয়ে বলল,----হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনস ডে।
----তোমাকেও -----বলে স্নিগ্ধা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা চকলেট বের করে দীপকে দিল। দীপ চকলেট সমেত স্নিগ্ধার হাতটা ধরে প্রায় কোলে তুলে নিয়ে ওর ঠোঁটে ডুব দিলো।
       প্রায় আধঘণ্টা ধরে পরান টুকটুক করে শুধু দুটো পাড়ার মধ্যেই রিক্সাটা ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। এমন সময় দীপ ঝাঁপটা তুলে বলল,-----পরানদা এবার বাড়ির দিকে চলো।
       স্নিগ্ধাকে নামিয়ে পাড়ায় ঢুকতে গিয়ে দীপ হঠাৎ বলে উঠল,------একটু দাঁড়াওতো পরানদা। এই মৌ, মৌ, এখানে কি করছিস?
----তোমার জন্যই দাঁড়িয়ে আছি দীপদা।----হাতে একটা প্লাস্টিকের থলে নিয়ে সবুজ শালোয়ার কামিজ পড়া মেয়েটা রিক্সার কাছে এগিয়ে এল।
----আমার জন্য? কেনো রে? কিছু দরকার আছে?
----আমার তোমার সঙ্গে কটা কথা ছিল দীপদা।
----তা বল না
----এখানে? একটু অন্য কোথাও যাওয়া যায় না? মানে একটু নিরিবিলি....
----অন্য কোথাও? আচ্ছা, আয়, উঠে আয় রিক্সায়। পরানদা----
----এঁজ্ঞে দীপদাদা ---
পরান আবার রিক্সাটা ঘুরিয়ে ডক্টরস কলোনির দিকে চলল। এতক্ষণ ধরে একটানা রিক্সা চালিয়ে খুবই হাঁপিয়ে গেছে সে। পেটের ব্যাথাটাও চিনচিন করে বাড়ছে। তবু দীপের মুখের ওপর কিছু বলতে পারল না।
ডক্টরস কলোনিতে ঢুকে দীপ বলল,----বল, কি বলবি বলছিলি?
----বলছি, আগে এটা নাও---- বলে মৌ প্লাস্টিকের প্যাকেট থেকে একটা লাল গোলাপের তোড়া বের করে দীপের হাতে দিলো।
----এটা কি?
----আচ্ছা দীপদা, তুমি কি কোনদিন বুঝতে পারোনি আমি তোমাকে কতটা ভালবাসি?
----কি বলছিস?
----হ্যাঁ গো! মাঝে মাঝে মনে হয় আমি পাগল হয়ে যাবো তোমাকে ছাড়া!
----তুই আগে কেনো বলিস নি রে যে আমাকে এত ভালোবাসিস?
----এখন তো বললাম, এখন আমাকে তোমার করে নাও।-----বলে হাতদুটো বাড়িয়ে দিল মৌ।
দীপ সেই হাত ধরে মৌ কে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে নিলো।
         অন্ধকার রাস্তাটায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল পরান। আর টানতে পারছে না রিক্সাটা।দীপদাদা নিশ্চয় বকবে এই ভেবে পেছন ফিরে তাকাতেই থ হয়ে গেল। মৌকে কোলে বসিয়ে গভীর চুম্বনে ব্যস্ত দীপ। তার একটা হাত মৌ কে পেঁচিয়ে ধরে রয়েছে; আর একটা হাত চলে গেছে ওর বুকে। আগেরবার তবু ঝাঁপটা টেনে দিয়েছিল। এবারে সেই সবুরটুকুও সয় নি। পরান ধীরে ধীরে রিক্সা থেকে নেমে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।
মিনিট পনেরো পরে দীপ ডেকে বলল,----পরানদা, এবার চলো।
          পাড়ার মোড়ে মৌকে নামিয়ে দেওয়ার পর পরান জিগ্গেস করল,----আচ্চা দীপদাদা, তবে কি ওই আগের দিদিমণিট তুমার বৌ হবেক নাই?
----কি বললি? রিক্সা থামা, থামা বলছি!----রেগে লাল হয়ে গেল দীপ -----শালা ছোটলোক! দুটো ভালো করে কথা বলেছি তো মাথায় চাপতে চাইছে! এই নে তোর টাকা। ভাগ শালা!-----বলে দীপ একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে পরানের গায়ে ছুঁড়ে দিয়ে হনহন করে চলে গেল। পরান কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে টাকাটা কুড়িয়ে পকেটে পুরল। রিক্সাটা ঘোরাতে গিয়ে দেখল লাল গোলাপের তোড়াটা রাগের মাথায় দীপ রিক্সাতেই ফেলে গেছে। অত সুন্দর অতগুলো ফুল ফেলে দিতে মন চাইল না। সিটের নিচে সযত্নে ঢুকিয়ে রাখল। ফুলিটাকে দিলে খুশি হয়ে যাবে। আর আজকে ভাড়া চালাতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। পেটের ব্যাথাটাও বেড়েই চলেছে।

(২)

   এই সকালবেলাটায় ফুলির খুব তাড়াহুড়ো পড়ে যায়। ভোর থেকে উঠে অবধি ঘর, বাসন, কাপড়; তারপর চান করে রান্না বসায়। তারপর ছেলেদুটোকে ঘুম থেকে টেনে তুলে স্কুলের জন্য তৈরি করা। ছেলেদুটো যতক্ষণে বইখাতা গুছাতে থাকে ততক্ষণে চাট্টি আলুভাতে-ভাত মেখে নিজেই খাইয়ে দেয় ওদেরকে। দুপুরের খাবারটা স্কুলেই পাওয়া যায়। তাই খানিকটা নিশ্চিন্তি। ওদেরকে পlঠিয়েই স্বামীর জন্যেও ভাত বেড়ে দেয়। সেও তো বেরাবে কাজে! তারপর নাকে মুখে চাট্টি গুঁজে নিজেও বেরিয়ে যায়। এই এত কিছু ফুলিকে করতে হয় সকাল ন'টার মধ্যে। ন' টার মধ্যে না পৌঁছালে বৌদিমণি খুব রাগ করে, চেঁচামেচি করে। আজ তো খুব দেরি হয়ে গেছে। ঘর থেকে বেরিয়েইছে ন'টার পর। আজ কপালে ঝামেলা লিখেছে!
ঠিক তাই! ঢোকার সাথে সাথে বৌদিমণি শুরু হয়ে গেল-----ফুলি, তুমি আজ আবার দেরি করলে? ওটির দিনগুলোতেই তোমার দেরি করা পায় না?
----মরদটর শরীলডা ভালো নাই গো বৌদিমণি, প্যাটট মেলায় বাজছে গো!
----এই তুমি চুপ কর তো! তোমার ওই রোজকার প্যানপ্যানানি আর ভালো লাগে না। তোমার বরের লিভারটা পচে গেছে শোন। যা গেলে দিনরাত! ওসব ছাড়ো। আমাদের বেরোনোর সময় হয়ে গেছে। টিয়ার আজ তাড়াতাড়ি ছুটি হবে। আড়াইটার সময় আসবে। খাবার টাবার গরম করে দিও। আমাদের আজ অনেকগুলো ওটি আছে। ফিরতে সন্ধ্যে হবে।
      এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে বৌদিমণি ভেতরে চলে গেল। স্বামী স্ত্রী দুজনেই ডাক্তার। একই নার্সিংহোমে আছে। তাই রোজ একসঙ্গেই যাওয়া আসা করে। ওরা বেরিয়ে গেলে ফুলি নিজের মত করে ঘরের কাজকর্মে মন দেয়। রান্নাটা অবিশ্যি করতে হয় না। ওটার জন্যে অন্য একটি লোক আছে। সকালে একবার আর রাতে একবার এসে করে দেয়। ফুলির কাজ হল সংসারটাকে গুছিয়ে রাখা। বাসন, কাপড়, ঘর সবকিছুই তার দায়িত্ব। তারপর চারটে নাগাদ টিয়া দিদিমণি আসলে তাকে খাবার খাইয়ে পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ তার ছুটি হয়। আজ আবার টিয়া দিদিমণি তাড়াতাড়ি ফিরবে! ফুলি আর দেরি না করে লেগে পড়ল।
       ঘরে ঢুকেই দুম করে বইএর ব্যাগটা সোফায় ছুঁড়ে দিয়ে টিয়া চিৎকার শুরু করল,----ফুলি, ও ফুলি, এক গ্লাস জল দাও না গো।
----এই যে দিদিমণি
এক চুমুকে জলটা শেষ করে টিয়া বলল,----শোন, একটু পরে আমার কয়েকজন বন্ধু আসবে। কোল্ড ড্রিংকটা ফ্রিজ থেকে বের করে রাখো। ওরা এলে স্ন্যাকস আর ড্রিংকটা দেবে কেমন ?
ফুলি মাথা নেড়ে রান্নাঘরে চলে গেল।
        মিনিট পনেরো পরেই ডোরবেল বাজল। ফুলি গিয়ে দরজা খুলে দিল। দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে, টিয়ারই বয়সী হবে, হাতে লাল গোলাপ চকলেট এই সব নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদেরকে ভেতরে নিয়ে এসে টিয়ার ঘরে বসাল ফুলি। টিয়াও ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে এসে গেছে।
----এসে গেছিস? ফুলি ------
----আনচি গো
একটা ট্রে তে কোল্ড ড্রিংকস আর চিপস নিয়ে এসে টি টেবিলটাতে রাখল ফুলি।
----এবার তুমি যাও ফুলি, আর যাবার সময় দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যাও।
        নিজের মনে কাজই করছিল ফুলি। হঠাৎ দিদিমণির ঘরের ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে চোখ পড়তেই চমকে গেল। ঘরের ভেতরে দুটি ছেলে দুটি মেয়েকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে! কতই বা বয়েস হবে দিদিমণির? ষোল-সতের বড়জোর! বিহ্বল হয়ে এই  কাণ্ড দেখতে দেখতে ভুল করে দরজায় হাত পড়ে গেল। দরজাটা একটু শব্দ করে খুলে গেল। ফুলি চট করে সরে গেল। কিন্তু ততক্ষণে টিয়া দেখে ফেলেছে!
----ফুলি, কি করছ তুমি এখানে? নজর রাখছো আমার ওপর?
----না, না গো দিদিমণি
----না গো মানে? আমি পরিষ্কার দেখলাম!
----মাপ কদ্দাও গো দিদিমণি। ঝাঁট দিতে দিতে হয়ে গেচে গো
----মিথ্যা কথা বলছ? দাঁড়াও আজ বাপি মামনি আসুক! তোমার হচ্ছে!
      একটু পরেই ছেলেমেয়েগুলি চলে গেল। টিয়াও ফোনটা নিয়ে সোফায় বসে কার সঙ্গে জানি কথা বলতে শুরু করল।
----মেজাজটা খিঁচড়ে গেল রে! কাজের মেয়েটা এমন বজ্জাত! আয় না একটু রিফ্রেশমেন্টের দরকার খুব।
তার আবেদনে যে উল্টোপক্ষ সাড়া দিয়েছে একটু পরেই তা বোঝা গেল।
ছেলেটি ঘরে ঢুকতেই টিয়া তাকে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে দরজায় খিল দিল। এবারে আর সে মেজাজ খারাপ করতে চায় না।
         দরজার ওপার থেকে মনিবের মেয়ের শীৎকার শুনে ফুলির গা শিরশির করে উঠল। দুটি ছেলের মা হলেও যৌবনটা  তো তার এখনো শেষ হয়ে যায় নি! পরানটা তো তাকে কোনদিন ভালো করে চেয়ে দেখলই না। আর এখন আবার শরীরে রোগ ধরেছে!

(৩)


     বাড়ি ফেরার সময় আজ একটু গন্ধ চাল আর দুধ কিনে নিয়ে ফিরল ফুলি। দুর্গাপূজোর অষ্টমীর দিনে মনিবের ঘর থেকে নিয়ে আসা ভোগের পায়েসটা খেয়ে অবধি ছেলে দুটো আর পরানটা যা বায়না জুড়েছিল! এখনো  দু-চারদিন ছাড়া ছাড়াই হিড়িকটা চাগিয়ে ওঠে। তাই আজ ভাবল একটু বানিয়েই দেবে ওদেরকে। মনটা আজ বড় ফুরফুরে লাগছে। দিদিমণির কাছে বকাঝকা খেয়ে কিছুক্ষণের জন্য একটু খারাপ লাগছিল বটে, কিন্তু এখন আবার বেশ লাগছে। কে জানে হয়ত ওই বাবুদের ছেলেমেয়েগুলোর উৎসব, কি যেন বলছিল---- হ্যাঁ ভেলোটিন ডে না কি, হয়ত তার জন্যই হবে! দুগ্গাপুজোর সময় যেমন বাতাসে একটা ফুর্তি মিশে থাকে, নতুন শাড়ি না জুটলেও যেমন আনন্দে টইটই করতে ইচ্ছে করে, আজ ঠিক সেরকমই হচ্ছিল ফুলির। এ এক নতুন পুজো এসেছে বটে! গাঁয়ে থাকতে তো এই ভেলোটিন পুজোর নামও কখনো শোনেনি সে। অবিশ্যি গাঁয়ে থাকতে পুজো আচ্চা পালন করার মত সংস্থানই বা তাদের ছিল কোথায়? পিঁপড়ের ডিম আর ঘাসের বীজ খেয়ে খেয়ে পিলে ঠিকরে শরীর থেকে বেরিয়ে আসার জোগাড়! সেসব দিনের কথা চিন্তা করলেও গা শিউরে ওঠে। তারপর একদিন সব পিছুটান ফেলে, ছেলে দুটোর একটাকে কোলে আর একটাকে পেটে নিয়ে দুটি ভাতের আশায় ওরা দুটিতে চলে এসেছিল এই বিদেশ বিভুঁইয়ে। সম্বল বা সহায় বলতে ছিল একমাত্র গাঁয়ের মধুদাদা; যে কয়েক বছর আগেই চলে এসেছিল গাঁ ছেড়ে। মধুদাদা সেইদিনই পরানকে নিয়ে গিয়ে তার মালিককে ধরে একটা ভাড়া রিক্সার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সে আজ কতদিন আগেকার কথা! তা বছর আষ্টেক তো হবেই। বছর খানেক পরে ফুলির এই ঠিকা কাজটাও জুটে গেল।ধীরে ধীরে নিজের সংসার গুছালো সে।ছেলেদুটোকে ইস্কুলে পড়াবার যে সুপ্ত ইচ্ছাটা ছিল, খেয়ে না খেয়ে সেটাকেও পূরণ করল। সবই ঠিক চলছিল। বাধ সাধল পরানের ওই চোলাইয়ের নেশাটা!
       ঘরে ঢুকে ফুলি দেখল ছেলেগুলো এক জামবাটি মুড়ি নিয়ে বসেছে।
----তুদের বাপ ফিরে নাই অ্যাকুনো?
----না ----মাথা নেড়ে ওরা আবার মুড়িতে মন দিল।
কাজে যাবার আগে পরানকে বিকেলে বেরাতে বারণ করেছিল ফুলি। পেটের ব্যাথাটা দুদিন ধরে খুব বেড়েছে। ডাক্তারবাবু সেদিন বলল এক ফোঁটা মদও এখন ওর জন্য বিষ। তাও পরশু রাতে গিলে চলে এসেছিল! সেই রাত থেকেই ব্যাথাটা খুব বেড়ে গেল। ফুলি তাড়াতাড়ি করে রান্নাটা সেরে নিল। ছেলেগুলো বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারেনা। তাই ওদের খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। তারপর নিজে ছোট্ট আয়নাটা নিয়ে বসল। চুলে তেল দিয়ে বেণী বাঁধল, বড় করে একটা সিঁদুরের টিপ বানিয়ে একমাথা সিঁদুর পড়ল। আজ উৎসবের দিনটাতে একটু না সাজলে যে পরানের মুখে হাসি ফুটবে না। মানুষটা এমনিতেতো খারাপ নয়!
       ছেলেদের পাশে শুয়ে একটু ঘুমিয়েই পড়েছিল ফুলি। পরানের ডাকে ঘুম ভাঙ্গল। দরজা খুলতেই এক তোড়া লাল গোলাপ ফুলির   হাতে ধরিয়ে দিয়ে পরান বলল,----লে, আজ উ ভেলোটিন ডে ট বটে, তুর লেগে লিয়ে এলুম।
ফুলির মুখে খুশির বন্যা বয়ে গেল। তাড়াতাড়ি এক বাটি পায়েস নিয়ে এসে পরানের মুখের সামনে ধরে বলল,----তুর লেগে বানাইছি।
পরান পেটটা চেপে ধরে ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়ল।
----আয় ক্যান্নে, তু ও আয়, সঙ্গতে খাবি
----তু এগুতে খা----বলতে বলতে ফুলি পরানের পাশে এসে বসল। পরানও ধীরে ধীরে ফুলির কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল
----ফুলি আজ কত্তদিন পরে এমন সাজ্লি
----তুর লেগেই তো সাজ্লুম
----আচ্চা ফুলি, মু মরলে তু আবার ঘর ট বাঁধবি? কুনু মরদের সঙ্গতে?
ফুলি পরানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,----আজ পেত্তম তু মুর লেগে ফুল ট লিয়ে এলি রে
----তু যদি আবার ঘর ট বাঁধিস তবে নুনু গুলানকে ছেড়ে ট দিস না রে! উয়াদিগে সঙ্গতে লিয়ে ট যাবি
----এগুতে তো কুনু দিন তু এমন কলট তে শির ট টিকায়েঁ সুস নাই---
----ফুলি রে, আজ প্যাট ট গেদে বাজচে রে, আর লারচি রে
----এগুতে তো কুনু দিন তু এমন সুহাগ ট করিস নাই
----ফুলি রে, বড বাজচে
----উ বাবুদের ছিলা মিয়া গুলানের থিকে মুদের ভেলোটিন ডে টই ভালো রে পরান
----ফুলি ----
----উয়াদের মতন মুর দশ ট মরদ নাই রে, আর তুর ও দশ টা মিয়াছিলা নাই, তুয়েই মুর আজম্ম কালের সাথী রে পরান! উয়া দের থিকে মুদের টই ভালো
       শক্ত করে ফুলির আঁচলের খুঁটটা ধরে থাকা পরানের মুঠোটা আস্তে আস্তে খুলে গেল, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া শরীরটাও ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে গেল। কোন কথা আর  সে শুনতে পাচ্ছে না। ফুলির আজম্ম কালের একমাত্র ভ্যালেন্টাইন চলে গেছে অনেক দূরে.......
                               
(সমাপ্ত)
____________________________
© মমতা সিনহা

Monday, 13 February 2017

।। গহ্বর ।।


                         (1)
          বিকেলটা মন্দ কাটে না অনুর, সামনের বাগানে বা ছাদে মিষ্টি হাওয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা আর সাথে এক কাপ চা.....বেশ লাগে।কিন্তু সন্ধ্যে নামলেই এক রাশ ভয় এসে জাপটে ধরে অনুকে। তার শ্বশুরবাড়ি যাকে বলে জমিদার বাড়ি। এত্তো বড়ো বাড়িতে লোক মাত্র ছ'জন, অনুকে নিয়ে, তাও ছ'জনও ঠিক-ঠাক নয়। অনুর স্বামীর তরফে অনু, অনুর স্বামী প্রতাপ আর এক বুড়ি পিসিমা। প্রতাপের কাকার তরফে থাকেন কাকা, কাকিমা আর ছেলে প্রদোষ। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে দূরে কোথাও। তাদের বাপের বাড়ি আসতে খুব একটা দেখেনি অনু। বরং কাকা কাকিমাকে মেয়েদের বাড়ি যেতে দেখেছেন বার দুয়েক। আর প্রদোষ কি করে, কখন বাড়ি থাকে বা থাকে না তার কোনও ধারণাই নেই অনুর। কারণ কাকার সাথে প্রতাপের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। আর কাকারা থাকেন বাড়ির দক্ষিণ দিকের সামনের অংশে, অনুরা উত্তরের শেষের দিকটায়। কেউ মারা গেলে যতক্ষণ না খবর দেওয়া হচ্ছে, দুই পরিবারের কেউ কিছু টেরও পাবে না। আরও কিছু শরিক আছে এই বাড়ির। কেউই এ বাড়িতে থাকে না, কলকাতা, চেন্নাই...... সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বিয়ের সময় সেই সব শরিকদের কয়েকজনকে দেখেছিল অনু। টিকলু বলে লতায় পাতায় এক ননদের সাথে তো বেশ ভাবই হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের পরের এক সপ্তাহ এই টিকলুই ছিল তার সর্বক্ষণের সঙ্গী। সেই টিকলুই তাকে এ বাড়ি নিয়ে কিছু ভুতের গল্প বলেছিল। এই জাতীয় পুরনো জমিদার বাড়ি নিয়ে দু-দশটা ভৌতিক ঘটনা লেজের মতো জুড়ে থাকে, এটা অনু জানে। তাই গল্পগুলো শুনে খুব একচোট হেসেছিল। কিন্তু পাঁচ জনের মাঝে ভুতকে নিয়ে হাসাহাসি করা আর সারাদিন একটা পোড়া জমিদার বাড়িতে প্রায় একলা থাকা...দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। তাই সন্ধ্যে নামলেই ভয় লাগতে শুরু করে অনুর। কেমন যেন অস্বাভাবিক।

                      (2)
             প্রতাপও কী একটু অস্বাভাবিক নয়? প্রশ্নটা মাঝে মাঝেই চক্কর কাটে অনুর মাথায়। মা তেমন কিছু খোঁজ খবর না নিয়েই দুম করে জুড়ে দিল প্রতাপের সাথে। ' ওঠ ছুঁড়ি তোর বে'- র মতো ব্যাপার। ছেলে চেহারায় রাজপুত্র, ব্যবসায়ে ভাল আয়, বুড়ি পিসি ছাড়া সংসারে তেমন ঝামেলা নেই, তারওপর জমিদারের রক্ত গায়ে। যেটা অনুর মাকে সবচেয়ে বেশি বশ করলো তা হলো বিনা পণ, কোনও দাবি দাওয়া নেই ছেলের।  বাবা মারা গেছে সেই কবে, অনু তখন সবে মাত্র ক্লাস এইট। বাবার পেনশন আর জমা টাকার সামান্য সুদে সংসার চালানো যে কতো কষ্টের সেটা অনু বুঝতো। তাই এই সম্বন্ধ যখন এলো, পাত্র অনুর থেকে বেশ খানিকটা বড়ো জেনেও অনু আপত্তি করেনি। আর ' জমিদার বাড়ি ' ব্যাপারটাই কী রোমান্টিক না! কিন্তু রোমান্টিকতার এই রেশ মাত্র সাড়ে তিন মাসেই তলানিতে ঠেকেছে। বিধবা পিসিমাটি সারাদিন পুজো-আচ্ছা নিয়ে থাকেন, তারওপর ছোঁয়াছুয়ির বাতিক। কি কথা বলবে এর সাথে অনু! আর প্রতাপ সারাদিন ব্যস্ত। প্রতাপের কীসব ইমপোর্ট - এক্সপোর্টের ব্যবসা --- শুধু এইটুকু ছাড়া আর কিচ্ছু জানে না অনু। এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে প্রতাপ গাছাড়া উত্তর দেয়। কিন্তু এটাই বা কেমন ধারা ব্যবসা! কখনও রাত বারোটায় ফিরছে, কখনও রাত কাবার, কখনও এলোই না।কাজের মাসি পূর্ণিমাদি এ বাড়িতে অনেক দিনের, তার কাছেও শুনেছে ওর কাজের ধরনটাই এমন, এমনটাই পূর্ণিমাদি দেখে আসছে বছরের পর বছর। এই সাড়ে তিন মাসে মাত্র তিন/চারবার অনুর শরীর ছুঁয়েছে প্রতাপ, তাও সেই স্পর্শ,  সেই মিলন যেন প্রাণহীন, যেন একটা দায়। আদর জিনিসটা যে কি - প্রতাপ মনে হয় জানেই না। প্রতাপের জীবনে অন্য কেউ আছে কি.....এ সন্দেহও হয়েছে মনে। কিন্তু প্রতাপ এতটাই কাঠখোট্টা, এতটাই রসকষহীন যে অনুর একটু খটকা লাগে। প্রমাণ খুঁজতে গিয়ে  ঘরের জিনিসপত্রের কম তল্লাশি চালায়নি অনু। কিচ্ছু পায়নি। অনুর আনমনা ভাবটা টের পেয়েই হয়তো প্রতাপ কিছু দিনের জন্য বাপের বাড়ি ঘুরে আসার পরামর্শ দিয়েছিল। গিয়েও ছিল অনু। কিন্তু দু'কামরার ছোট বাড়িতে দুদিনেই হাঁফিয়ে উঠলো। শ্বশুরবাড়িতে আর যাই হোক বেশ হাত পা খেলিয়ে থাকা যায়। মাত্র ক'মাসেই অনুর এই নির্লজ্জ পরিবর্তন অনুকে বিব্রতই করেছিল। কোনও সামঞ্জস্য নেই, তবুও অনু তখনই ঠিক করে, শ্বশুরবাড়ির তাদের অংশটা এখনও পুরোটা ঘুরে দেখা হয়নি। বাপের বাড়ি থেকে ফিরেই অনু সেই কাজে লেগে গেল।

                              (3)
                   এমাথা থেকে ওমাথা লম্বা দালান, দালানের পাশে সারিবদ্ধ ঘর। বড়ো বড়ো ভারি দরজা, সবগুলোয় ইয়া মোটা মোটা তালা লাগানো। শাড়ির খসখস বা দরজা ঠেলার শব্দে ফড়ফড় করে শতখানেক পায়রা উড়ে অনুর বুক খালি করে দেয়। তালা লাগানো দরজাগুলো ঠেলে যে সামান্য ফাঁক হয় তাতে চোখ রাখলে একটা অন্ধকার ঘরের আবছা আকার টের পাওয়া যায়। জানলার খড়খড়ি দিয়ে যে সামান্য দিনের আলো ঘরে চুঁইয়ে পড়ে তাতে দু-একটা আসবাবের আদল আসে, বড় আরাম কেদারা বা পালঙ্ক বা গ্র্যান্ড ফাদার ক্লক।অনুর বেশ লাগে কিন্তু। নিজেই কতো কিছু কল্পনা করে, তারপর কতোটা উদ্ভট সেই কল্পনা ভেবে নিজেই হাসে। বারান্দার একদম শেষে, একটু অন্ধকার মতো, ঠিক করে খেয়াল না করলে চোখে পড়ে না, একটা ঘোরানো সিঁড়ি অনুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে হঠাৎ করে একটা বড়ো সড়ো দরজা দেখে থমকে যায় অনু। দরজাটা অন্যগুলোর মতোই তবে তালাটা একেবারে নতুন, আগের গুলোর মতো পুরনো নয়। দরজার ফাঁক থেকে দেখা যায় সিঁড়িটা ফের ঘুরে খানিকটা নেমে গেছে। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। হঠাৎ করে এই দরজায় নতুন তালা কেন লাগানো হলো- এটা জানতে হবে অনুকে। প্রতাপের কাছেই জানতে চাইবে। কিন্তু এমনই কপাল প্রতাপ ফিরলোই অনেক রাত করে। কটায় অনু জানে না, প্রতাপের জন্য আর জেগে বসে থাকে না। তবে টের পেল প্রতাপের পাশে এসে শুয়ে পড়া। এরপর থেকেই ঘুমটা কেমন যেন ছাড়াছাড়া হল। পৌনে পাঁচটা নাগাদ বিরক্ত হয়ে উঠেই পড়ল। ছাদে বসে এই সময় এক কাপ চা খাওয়ার চিন্তাটাই অনুকে চনমনে করে তুললো। প্রতাপকে বলতে হবে ছাদে একটা ইজিচেয়ারের ব্যবস্থা করে দিতে। চিন্তাকে অনুসরণ করে অনু প্রতাপের দিকে তাকাতেই চমকে উঠল। প্রতাপের ডান পায়ে চার আঙুলের আঁচড়ের দাগ! কোনো একটা ক্রীম জাতীয় কিছু লাগানোর পরেও রক্ত শুকিয়ে আছে সেখানে। তাহলে কি .......... ধ্যাত্! প্রেমিকা পায়ে আঁচড়ে দেবে নাকি!? হলে পিঠে বা হাতে হতো। খালি গায়ে শুয়ে থাকা প্রতাপের শরীরে তেমন কোনও প্রমাণ নেই। পায়জামাটা শোবার দোষে খানিকটা উঠে গেছে, গোড়ালির একটু ওপর আঁচড়ের দাগগুলো পায়জামার ভেতরে মিলিয়ে গেছে। পায়জামাটা আলতো করে তুলতেই প্রতাপ ধড়ফড় করে উঠে বলে
- কি হয়েছে?
- তোমার পায়ে আঁচড়ের দাগ কেন?
- আঁচড় কোথায়! কাল বাইক থেকে পড়ে গেছি
- ওমা! আর কোথাও লাগেনি তো?
- না, পা-টা একটু ছড়ে গেছে
- হাড়-টাড় ভাঙেনি তো!?
- হাড় ভাঙলে লোকে ঘুমিয়ে পড়তে পারে!?
বিরক্ত প্রতাপ বাথরুমে চলে গেল। নাকি অনুকে এড়াতে? বাইক থেকে পড়ে গিয়ে সারা শরীরে কিছু হল না, শুধু ডান পা ছড়ে গেল? আর ওটা কিছুতেই ছড়ে যাওয়ার ক্ষত নয়। কথা বাড়ায় না অনু, লাভ নেই তাই, সত্যিটা প্রতাপ বলবে না। কিংবা প্রতাপ হয়তো সত্যিই বলছে।

                     (4)
        দুপুরগুলো কিছু দিন আগে পর্যন্ত কাটতেই চাইতো না অনুর। এখন একটা নতুন খোরাক পেয়েছে, একটা টর্চ নিয়ে বন্ধ ঘরগুলোয় উঁকি মারা। চাবি দিতে পিসিমা আপত্তি করেননি তবে সাবধান করে দিয়েছেন, ওদিকে নাকি বিশেষ লোক যাতায়াত নিই, সাপ-খোপের আড্ডা। ওসব ভেবে লাভ নেই। সারাদিন করবেটা কি অনু? রান্নাঘরে ঢোকার হুকুম নেই , এ বাড়ির বৌরা নাকি রান্না করে না। পুরো ব্যাপারটা পূর্ণিমাদির হাতে। আজব নিয়ম! রোজ রোজ এতোখানি লম্বা সময় নিয়ে কি করবে? কাঁহাতক আর টিভি দেখা যায়? বইয়ের নেশা অনুর নেই। তারচেয়ে গোটা বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরতে ভাল লাগে। দুপুর হতেই তাই বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু একটু হতাশই হতে হলো অনুকে। দরজার তালাগুলো মরচে পড়ে একেবারে শক্ত হয়ে আছে। কার সাধ্য খোলে! অগত্যা এধার ওধার করতে করতে ফের সেই আধো অন্ধকারময় ঘোরানো সিঁড়ি, ফের সেই ভারি দরজা। অনু বোঝে না কেন এই দরজা তাকে তীব্র আকর্ষণ করছে। কাল রাতে, ছবিটা ঠিক পরিষ্কার নয়, তবে মনে হয় এই দরজাটাকেই স্বপ্পে দেখেছিল। প্রত্যেকটা চাবি তালায় লাগিয়ে চেষ্টা করলো। নিষ্ফল প্রচেষ্টা। অনু একটু অবাক হলো এই ভেবে যে তালাটা নতুন, বাকিগুলোর মতো মরচে ধরে শক্ত হয়ে যায়নি যে চাবি থাকলেও খুলবে না। তার মানে চাবির গোছায় এই তালার চাবি নেই। তারপর কোনো কিছু না ভেবেই অনু দরজাটায় জোরে জোরে ধাক্কা দিতে শুরু করলো। তালা ভেঙে পড়বে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই, অনুও ভাবেনি। তবে সব কাজের কী সব সময় ব্যাখ্যা হয়। ধাক্কাধাক্কির পর পায়ের কাছে রাখা টর্চটা তুলতে যাবে, অনুকে সম্পূর্ণ হতভম্ব করে দিয়ে শেকলের ঝনঝন শব্দ পেলো। দরজার ওপাশে সিঁড়ি নেমে গেছে নীচে, কতো নীচে এখন থেকে বোঝা যাচ্ছে না, সেই নীচের থেকেই শব্দটা আসছে। খুব ক্ষীণ যদিও, কিন্তু চারপাশটা এতো শান্ত আর নিস্তব্ধ যে সামান্য হলেও শব্দটা কানে আসে। টিকলুর কাছে শোনা গুম ঘরের গল্পগুলো মনে পড়ছে। ভয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল অনু, নড়াচড়ার যেন ক্ষমতা নেই। পা দুটো মাটিতে গেঁথে গেছে। একপ্রকার অজান্তেই অনুর মুখ থেকে বেরিয়ে গেল 'কে'? নিজের গলার স্বর নিজেই চিনতে পারছে না অনু। ফের সেই শেকলের শব্দ! অনু আর দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পেলো না।

                              (5)
              সেদিনের পর থেকে প্রতাপ শোবার ঘর আলাদা করে নিয়েছে। কারণ হিসেবে জানালো ওর নাকি আসা যাওয়ার ঠিক নেই, অনুর ঘুমের অসুবিধা হতে পারে। অনুর আপত্তি শোনার দরকারও মনে করেনি। অবশ্য অনুর কোনটাকেই বা প্রতাপ গুরুত্ব দেয়। অনুর কোনো কিছুতেই প্রতাপের কোনও আগ্রহ নেই। রাগ, অভিমান, মনকেমন, মনখারাপ - কোনও কিছু নয়।যেন  বিয়ে করতে হয় বলে করা। ওদের আলাদা শোবার ব্যাপারটা পিসিমাকে আলাদা করে বলতে হয়নি, নিজেই টের পেয়েছেন। সন্ধ্যা আরতির পর সেদিন অনেক ফল সন্দেশ প্রসাদ হিসেবে দিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে বেশ খানিকটা আদর করেই পিসিমা অনেক কিছু বললেন। মেজাজি, জমিদারি রক্ত, মেয়েদের কতো মানিয়ে চললে সংসার সুখের হয়, হেন, তেন। কিন্তু অনু বোঝাতে পারে না বিয়ের মাত্র সাড়ে তিন মাসের মধ্যেই কোনও স্বামী-স্ত্রীর শোবার ঘর আলাদা হয়ে যায় কি? এটা কি স্বাভাবিক? স্বাভাবিক আরও অনেক কিছু হতে পারতো কিন্তু হচ্ছে না। প্রতাপ পিসিমার সাথে গল্প করতেই পারে। বস্তুত পিসিমার হাতেই প্রতাপ মানুষ। প্রতাপ তার বাবাকে বলতে গেলে দেখেইনি। অল্প বয়সে ওর মাও মারা যান। এক্ষেত্রে পিসিমাই প্রতাপের জীবনে বাবা-মা, দুজনের ভূমিকা পালন করেছেন। কাজ যতোই থাকুক, সারাদিনে একবার অন্তত প্রতাপ পিসিমার কাছে বসে কথাবার্তা বলে। কিন্তু ওদের কথার মাঝে অনু গিয়ে পড়লে কেন ওরা চুপ করে যায়? বা বোঝাই যায় প্রসঙ্গ পাল্টাচ্ছে। একথা কাউকে জিজ্ঞাসা করার নয়। এতো অনুর সন্দেহ মাত্র। আরও আছে। ছোঁয়াছুয়ির জন্য পিসিমা নিজের কাপড় নিজেই যেভাবে পারেন কেচে নেন, কাউকে হাত দিতে দেন না। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক ছিল প্রতাপ আর অনুর জামাকাপড় একসঙ্গে কাচা। না, সেটা হয় না। বরং অনু খেয়াল করেছে প্রতাপের জামাকাপড় অনুকে আড়াল করে রেখে কাচা হয়। এখানেও কিছু বলার নেই কারণ এটাও অনুর সন্দেহ মাত্র। কিন্তু অনুর ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলে কিছু একটা আছে, কিছু একটা হয়। ওই দরজার ওপাশেও কিছু আছে। অনুকে জানতেই হবে সেটা কি। অনু খুঁজবে, খুঁজেই ছাড়বে।

                         (6)
             কিছুক্ষেত্রে সুযোগ মনে হয় সময়ের অপেক্ষা করে আর সময় সবার আসে, কারুর আগে, কারুর পরে। তাই অনুও একদিন সময় সুযোগ - দুটোই হাতে পেলো। কিছু বৈষয়িক আইনি জটিলতার কারণে প্রতাপকে দুদিনের জন্য কলকাতায় চলে যেতে হলো। কলকাতায় প্রতাপদের একটা বাড়ি আছে। অবশ্য নামেই, শরিকি ঝামেলা তো আছেই, তার ওপর একগাদা ভাড়াটে। বাড়ি দখল নেওয়া দূরে থাক, শরিকি ঝামেলাই মিটতে চায় না। কোর্টে হিয়ারিং-এর দিন পড়ে, প্রতাপকে যেতে দেখেনি, শুধু পিসিমার মুখে শুনেছে। কিন্তু এটা নাকি ভীষণ জরুরি। তাই খুব তাড়াহুড়ো করে সকাল সকাল প্রতাপ বেরিয়ে গেল। আটটা নাগাদ পিসিমা ঠাকুর ঘরে ঢোকেন, সাড়ে দশটার আগে বেরোনোর তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। পূর্ণিমাদি বাজারে। এর চেয়ে ভাল  সুযোগ অনু আর পাবে না। কিন্তু করতে হবে খুব নিঃশব্দে! পিসিমার বয়স হতে পারে কিন্তু চোখ কান যথেষ্ট সজাগ। কি খুঁজছে জানতে চাইলে অনুর কিছুই বলার মতো নেই। আর তাছাড়াও এই বুড়ি মানুষটাকে এসবের মধ্যে অনু টানতে চায় না। এবাড়িতে যে অল্প বিস্তর স্নেহ ভালোবাসা যা পেয়েছে তা এই পিসিমাই দিয়েছেন। নাহলে নিয়ম করে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে প্রতি দিন সন্ধ্যারতির পর অনুকে ফল মিষ্টি খাওয়াত না। অনু গরিব ঘরের বলেই পিসিমা খাওয়া-দাওয়ার খুব খেয়াল রাখেন। কতখানি স্নেহ থাকলে এমন হয়! না,  যা হবে সেটা ওর আর প্রতাপের মধ্যে হবে। প্রতাপ, হ্যাঁ, প্রতাপের ঘরটাই আগে খুঁজবে অনু। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে অনু শুরু হয়ে গেল। ঘরের প্রায় সব সম্ভব অসম্ভব জায়গা খুঁজে ফেলল অনু। ধুরর!! কোত্থাও কিচ্ছু নেই। আচ্ছা, এমন নয়তো যে অনু অহেতুক সন্দেহ করে প্রতাপকে? এমন তো হতেই পারে যে চাবিটা হারিয়ে গেছে? অনু তো চাবির ব্যাপারে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসাও করেনি। জিজ্ঞাসা করলে হয়তো বলে দিত। এমন নয়তো যে প্রতাপ তাকে পছন্দ করে না বলে অনুর অপছন্দটা অহেতুক সন্দেহের রূপ নিয়ে নিচ্ছে? অনুর মনে হলো এই একা থেকে থেকেই তার মাথায় মাথামুণ্ডুহীন চিন্তা ঘুরছে। খুব সহজ জিনিসকেও তাই জটিল করে তুলছে। এই নিয়ে আর ভাববে না অনু। নিজেকে অন্য কোনো উপায় ব্যস্ত রাখতে হবে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে অনু পিসিমার ঘরে ঢুকে বিছানা ঠিক করতে গিয়েই চোখে পড়লো একটা চাবি। সেই তালাটা যে কোম্পানির, চাবিটাও তাই। কিন্তু পিসিমার বিছানায় কেন? এর উত্তর অনুর কাছে খুব সহজ। তাড়াহুড়ো করে বেরোতে গিয়ে চাবিটা প্রতাপ পিসিমার কাছে নিশ্চয়ই দিয়ে গেছে, পিসিমা খুব স্বাভাবিক ভাবেই চাবিটা বিছানায় রেখে ঠাকুর ঘরে চলে গেছেন। যাবে নাকি একবার, দেখে আসবে নাকি চাবিটা ওই তালারই কিনা? চাবি নিয়ে অনু দে ছুট। দরজার কাছে পৌঁছে চাবির গর্তে চাবিটা ঢুকিয়ে একটা মোচড় দিতেই ক্লিক শব্দে তালাটা খুলে গেল।

                              (7)
      একটা টর্চ থাকলে ভাল হতো, কিন্তু এখন টর্চ আনতে গেলে ফের ছুটে ঘরে যেতে হবে, ফের ফিরে আসতে হবে, তাতে সময় নষ্ট।পূর্ণিমাদির ফিরে আসার সময় হয়ে এসেছে। থাক, টর্চ ছাড়াই অনু নামতে শুরু করে। ঘোরানো সিঁড়ি আরও খানিকটা ঘুরে নীচে নেমে গেছে। দেওয়াল ফাটিয়ে অশ্বত্থ, লতানে গাছের আবডাল। কেমন যেন একটা গন্ধ পুরো জায়গা জুড়ে। অনুর কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই এই ব্যাপারে। ক্রমশ মাটির তলায় নেমে যেতে থাকা সিঁড়ি, বদ্ধ বাতাস, চামচিকি আড্ডা - সব মিলিয়ে হয়তো এমন গন্ধই হয়। তবে পিসিমা একটা কথা ভুল বলেছেন। এখানে মানুষের যাতায়াত আছে, আবছা অন্ধকারেও সেটা টের পাওয়া যায়। সব ভুলে অনুর মনে এখন প্রচণ্ড কৌতূহল। সিঁড়িটা খানিকটা নেমে একটা ছোট্ট দালানে এসে থেমেছে, যার দুপাশে মাত্র দুটো ঘর। অনু প্রথমেই ঠিক করলো এখানে নিজের উপস্থিতিটা একদম গোপন আর নিস্তব্ধ রাখতে হবে। ঘরের মধ্যে যদি কেউ থেকেও থাকে সে যেন টের না পায় অনুর উপস্থিতি। যাতে প্রয়োজনে অনু ছুটে পালিয়ে যেতে পারে। হাতে একটা কিছু থাকলে ভাল হতো। সিঁড়ি পেরিয়ে দালানে আসতেই অনুর কানে এলো সেই শেকলের শব্দ, সাথে খুব ধীর ভাবে একটা গোঙানি। কান পাতার দরকার নেই, শব্দটা আসছে বাঁ দিকের ঘরটা থেকে। অনু ঠিক করতে পারে না কি করা উচিত। ফিরে যাবে? কিন্তু এই সুযোগ যদি ভবিষ্যতে আর না পায়? অন্তত এটা তো প্রমাণ হয়ে গেছে যে অনুর সন্দেহ অমূলক নয়। এবার শুধু জানতে হবে সেটা কি। আর সেটা না জেনে অনু এখান থেকে যেতে পারবে না। তাতে যা হয় হোক! আশ্চর্য এটাই যে দুটো দরজাতেই কোনো তালা নেই, ছেকল আটকানো। খানিকটা জড়তার সাথে ছেকল খুলে অনু যা দেখলো তাতে তার পায়ের তলার মাটি কেঁপে গেল। এতোটা নিজের দুঃস্বপ্নেও আশা করেনি অনু। একটা বাচ্ছা মেয়ে,  দশ কী বারো বছর বয়স, হাত-পা মোটা ভারি শেকল দিয়ে আটকানো, সম্পূর্ণ নগ্ন, মুখে কাপড় ঠুসে তার ওপর টেপ লাগিয়ে মুখ বন্ধ, সর্বাঙ্গে অসীম অত্যাচারের সাক্ষী হয়ে অনুর দিকেই ফিরে শুয়ে আছে। চোখ দুটো সম্পূর্ণ মৃত, মাঝে মাঝে হাত পা নাড়ানো বা মৃদু গোঙানির শব্দে বোঝা যাচ্ছে বেঁচে আছে। মেয়েটির পাশেই পড়ে আছে প্রতাপের একটা গেঞ্জি আর পায়জামা।              অনু আর সামলাতে পারছে না নিজেকে। সারা গা গুলিয়ে উঠেছে। অনুর চোখে অন্ধকার নেমে আসছে, অনু তার মায়ের কাছে ফিরে যেতে চায়, পরম নিশ্চিন্তে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়তে চায়। বাতাসে কিছু একটা ধরার নিষ্ফল চেষ্টা করে অনু সেখানেই নিজেকে এলিয়ে দিলো।

                                (8)
                  জ্ঞান ফিরতে অনু বুঝে উঠতে পারে না কোথায় সে। চেতনা এখনও পুরোপুরি ফিরে আসেনি। চোখেও কেমন ঝাপসা দেখছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। আর কিছু না হোক, একটু জল পেলেও অনু খানিকটা চাঙ্গা বোধ করতো। হাতে পায়ে অসহ্য ব্যথা। পাশ ফেরার চেষ্টা করলো অনু, পারছে না। সামান্য পাশটুকুও কেন ফিরতে পারছে না! জীবনের সব সমস্যা ভুলে এটাই এখন অনুর কাছে বড়ো প্রশ্ন। ভাল করে চারপাশে তাকাতেই পূর্ণিমাদিকে দেখতে পেলো। অনু চোখ মেলতেই পূর্ণিমাদি চলে গিয়ে, খানিকক্ষণ বাদে ফিরে এলো পিসিমাকে নিয়ে। তখনই খেয়াল হলো অনুর হাত পা পিছমোড়া করে বাঁধা, তাই হাতে পায়ে এতো ব্যথা। অনু মাথা তোলার চেষ্টা করতেই পিসিমা বললেন "কেমন লাগছে এখন"? কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না, ছবিগুলো অস্পষ্ট। একটা ছোট্ট মেয়ে, শেকল.......এগুলো কি আদৌ সত্যি না স্বপ্ন? ঘোর কাটলো পিসিমার পরের প্রশ্নে "ওখানে কি করতে গিয়েছিলি? চাবি কোথায় পেলি? আমার বিছানা থেকে"? অনু মরিয়া হয়ে বলল "পিসিমা, বাচ্ছা মেয়েটা এখনও বেঁচে আছে, ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াটা খুব জরুরি, তুমি একটু দেখো না"! "চোপ" - হুঙ্কার দিয়ে ওঠে পিসিমা। একটা আশি বছরের বৃদ্ধার গলা থেকে এমন বাজখাঁই আওয়াজ ভীষণ রকম ভাবে অপ্রত্যাশিত। কী তেজ! কী অহঙ্কার! কী আত্মবিশ্বাস! প্রায় স্বগতোক্তির মতোই পিসিমা বলে " রক্ত বুঝিস? রক্ত? জমিদারি রক্ত? আমরা জমিদার, আমাদের বংশের ইতিহাসেই আছে এমন। প্রতাপের পূর্বপুরুষরাও এই রকমই ছিলেন,  দু একজন ছাড়া। সেই জমিদারি আইন কানুনে হয়তো আর নেই, কিন্তু রক্তে, আজও আছে"।
               অনু হতবাক! শুধুমাত্র রক্তের দোহাই দিয়ে একটা লোক দিনের পর দিন শিশুদের ওপর নির্মম অত্যাচার করবে আর তার মাতৃসম পিসি তাকে শুধু সাহায্যই করছে না, উল্টে তার সপক্ষে যুক্তি খাড়া করছে! প্রতাপের চেয়ে গুরুতর ভাবে বিকৃত এবং মানসিক অসুস্থ পিসিমা। শৈশবে বাবা-মাকে হারিয়ে এই পিসিমার কাছেই প্রতাপ মানুষ হয়েছে। পিসিমা নিজেও নিঃসন্তান। পিসিমাই একমাত্র পারতেন এই বিকৃত রুচির হাত থেকে প্রতাপকে টেনে বের করতে। করেননি, উল্টে প্রতাপকে আরও ঠেলে দিয়েছেন অন্ধকারের দিকে। পিসিমা চাইলেই প্রতাপের চিকিৎসা করাতে পারতেন, করেননি কারণ পিসিমা নিজেই প্রতাপের চেয়ে অনেক বেশি অন্ধকার মনের মানুষ। অনুর মনে হতে লাগলো যে জমিদারি রক্তের কথা পিসিমা বার বার  বলছেন তার নিকৃষ্টতম উদাহরণ, এই পিসিমা নিজেই। রাগে সারা শরীর জ্বলছে অনুর। মনে হচ্ছে ছিঁড়েকুটে টুকরো  টুকরো  করে ফেলে পিসিমার সবটুকুকে। দুয়ে-দুয়ে চার করতেও অনুর আর অসুবিধা হয় না। অনুকে এবাড়িতে পিসিমা এনেছেন শুধু মাত্র সমাজের চোখে ধুলো দিতে। যাতে অনুকে সামনে রেখে প্রতাপ তার নারকীয়তা অবাধে চালিয়ে যেতে পারে। অথচ প্রতাপের চেয়ে পিসিমা অনেক বেশি জানতেন প্রতাপ পিডোফাইল। আজ অনু বোঝে কেন তাকে ছুঁতে প্রতাপের এতো অনীহা। কোনো পূর্ণবয়স্ক মহিলা প্রতাপের আগ্রহের বিষয় হতেই পারে না। কতো জন প্রতাপের এই অত্যাচারের শিকার অনু জানে না, জানতেও চায় না, শুধু ওই ছোট্ট মেয়েটাকে মনে পড়ছে। হয়তো ছাড়া পাওয়ার অনুনয়-বিনয় করতে গিয়ে প্রতাপের পায়ে নোখের আঁচড় বসিয়ে দিয়েছিল। বা হয়তো  পালিয়ে যাওয়ার একটা দুর্বল চেষ্টা। অজান্তেই অনুর দু-গাল ভেসে যাচ্ছে, অনু টেরও পাচ্ছে না

                               (9)
               কতক্ষণ অনু ওই ঘরে, ওই ভাবে পড়ে আছে তার হিসেব নেই। ঘরে কোনও ঘড়ি বা ক্যালেন্ডার নেই। জানলাবিহীন, নিরেট দেওয়াল, দিন-রাত বোঝার উপায় নেই। ম্যাড়মেড়ে বাল্বের আলোয় ঘরটাকে আরও কুৎসিত লাগছে। বাঁধনের জায়গাগুলোয় রক্ত জমে হাত পা অসাড়। শক্ত করে মুখ বাঁধা। কি করবে এবার অনু? কোনও দিন কি পারবে এই বাঁধন থেকে মুক্ত হতে? এতো কিছু জেনে যাওয়ার পরে অনুকে ছেড়ে দেওয়ার বিলাসিতা ওরা করবে না। তাহলে? অল্প শব্দেই সজাগ অনু, এখন। পূর্ণিমাদিকে ঘরে ঢুকতে দেখেই অনু চোখ বন্ধ করে ফেললো। কী শুরু হতে চলেছে কে জানে! আর কি কি কপালে লেখা আছে ? মুখের বাঁধনটা খুলে দিয়ে পূর্ণিমাদি জিজ্ঞাসা করে "উঠে বসতে পারবে"?
এতো মানসিক চাপ আর নিতে পারছে না অনু, ছেলেমানুষের মতো জিজ্ঞাসা করে "আমাকে কী তোমরা মেরে ফেলবে পূর্ণিমাদি"?
খানিকক্ষণ চুপ করে অনুর মুখের দিকে চেয়ে থেকে পূর্ণিমাদি বলে "হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিলে একা-একা পালাতে পারবে এখান থেকে"? নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না অনু! পূর্ণিমাদি বলছে এই কথা! এখান থেকে যদি পালাতে পারে তাহলে জীবনে আর কোনও দিন কিচ্ছু চাইবে না অনু। কিছু টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে পূর্ণিমাদি বলে "খিড়কির দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেবো, তারপর ভগবানের নাম কোরো। বাস অটো, যা পাবে উঠে পালাও। সবে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা বাজে, ন'টার আগে মনিরুল আসবে না"।
এতো কিছুর পরেও অনু না জিজ্ঞাসা করে পারে না "মনিরুল কে"?
- দাদাবাবুকে ও-ই ছোটো, ছোটো মেয়ে এনে দেয়। ওটাই ওর বিজনেস। আর কিছু জানতে চেওনা।
উফফফ! কী নরপিশাচদের পাল্লায় পড়েছে! এদের হাত থেকে মুক্তি দাও!
চাপা, রাগত স্বরে পূর্ণিমাদি বলে ওঠে "কান্নাকাটি পরে, আগে এই নরক থেকে পালাও। আমি বেশিক্ষণ এখানে থাকতে পারবো না, পিসিমার জপ শেষ হয়ে এলো বলে"!
             গায়ে তেমন জোর পাচ্ছে না অনু, সারা গা-হাত-পা অবশ মতন, কিন্তু ওকে পালাতেই হবে এখান থেকে। নাহলে এই চূড়ান্ত প্রতারণা, এই প্রচণ্ড মানসিক আঘাত, এই বদ্ধ ঘর আর চোখ বুজলেই একটা ছোটো মেয়ে - তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

                        (10)
                 আজ প্রায় ছ'মাস হলো, পুলিশ কারুর কোনো খোঁজ পায়নি, সব যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। যদিও ওই বাড়ির তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ এমন অনেক কিছু পেয়েছে যার সুস্থ মস্তিষ্কে কোনো ব্যাখ্যা নেই। আজকাল অনুর এই ব্যাপারে আর কোনও আগ্রহ নেই, আসলে আজকাল অনুর কোনো ব্যাপারেই আর কোনো আগ্রহ নেই। খুব নিস্পৃহ লাগে আজকাল। একবার, মাত্র একবার অনু জানতে চেয়েছিল ওই বাড়িতে খুব আহত কোনও ছোট্ট মেয়েকে কেউ দেখতে পেয়েছে কিনা। তেমন আশাব্যঞ্জক কোনও উত্তর পায়নি। ব্যস, অনুর আগ্রহ এখানেই শেষ।
                আজ প্রায় ছ'মাস হলো, এখনও অনু পুরোপুরি সেই ঘটনার থেকে নিজেকে বের করে আনতে পারেননি। আজও অনুর কাউন্সিলিং চলছে, আর আজও মাঝে মাঝেই অনুর  স্বপ্নে খালি পায়ে, ফ্রক পরা দুদিকে দুটো ঝুঁটি দুলিয়ে একটা ছোট্ট মেয়ে এসে হানা দেয়।

(সমাপ্ত)
____________________________________________
© তৃণা মুখোপাধ্যায়


।। আমার চুমু ।।



আজও জানা হয়নি, কেন
চুমুর আলাদা দিন যে লাগে
বাস্তবে বা স্বপ্নে চুমু
মনের কোনে কামনা জাগে!
স্বপ্ন দেখি সব যুগলে
একটা করে চুমু বিলায়
পথের ধারের ঝুপড়ি গুলোও
গুনতিতে যেন বাদ না যায়!
স্বপ্ন দেখি চুমুর দিনে
বন্দুক নয়, হস্তে গোলাপ
চাইনা যুদ্ধ চাইনা দ্বন্দ্ব
আজ থেকে হোক শুধু প্রেমালাপ!
চুমুর দিনে শপথ থাকুক
যুদ্ধ নয় শান্তিই চাই
শাস্তি নয় চুমুতে এবার
শাস্তি পাক ঘুষখোরেরাই !
_____________________
© অর্ক সানা

।। প্রেম ও পরকিয়া ।।




কর্মক্লান্ত দিনমণি অস্থ যাবার ছলে যেমতি চুম্বন আঁকে প্রেয়সি নদীজলে, সেমতি কৃষিকাজ শেষে চাষীবৌ শুষে নেয় লাঙলের মাটি


কে আগে বাড়িয়ে ছিলো ঠোঁট
মেঘ না চাঁদ,
কে আগে বাড়িয়ে ছিলো হাত
নদী না তট

এক রাইকিশোরী দেখছিলো এসব
তাই তো বাঁশিসুরে হারিয়ে ছিলো লাজ



শীতের রোদের মতো নরম ওম লেগেছিলো ঠোটের কোনে, যদিও  চুম্বনের লোভ সামলাতে না পারা কমলালেবুর কোঁয়ার কোনো আফশোষ ছিলোনা, অথচ তাকেই কি না প্রাণ দিতে হয়েছিলো, দাঁতের নিদারুণ  প্রতিশোধে


ছেলেটিও কালো, বাঁশিটিও, শুধু সুরটা যেন মেঘলা আকাশের তামাটে চাঁদ,মহুয়া ঘ্রাণের মিশেল


মেঘের সুগন্ধ চেনে কাটা ফসলের মাঠ
পৌষালী কুঁয়াশা আড়াল করে দৃশ্যাবলি
আসলে ঐ মেঘ কুঁয়াশা আর ধুসর  একাকি কাটাফসলের মাঠ,
একে ওপরের মায়াজাল মাত্র,
শুধু চাষীবৌ জানতো এসব পরকীয়া

তাইতো নদীজলে হারিয়ে ছিলো সে,


চাঁদের অলৌকিক মায়াজাল ফুরালে, সকাল আসে


বৃষ্টি নয়, সেদিন আকাশ থেকে নোনতা জল ঝরবে, আর তুমি ছাতা খুলবে,যা তোমাকে ভিজতে দেবে না, তাও তোমার শরীর ভিজবে, তুমি টের পাবেনা, এভাবেই শয়তান তোমাকে আদর করবেন, অথচ তুমি বুঝতে পারবে না,  কারন তুমি রক্তের স্বাধ জানোনা,  যেহেতু তুমি রক্তস্বাধ জানোনা তাই তুমি বুঝতে পারবে না, তুমি ভাবতেই পারো এসব স্রেফ মনের ভূল, ফলতঃ তোমার স্বপ্ন চিরস্থায়ী হবে।।


শ্রীরাধিকার মৃতদেহটা এক টুকরো দেখে কানাই হাতে তুলে নিলেন বাঁশি, আর বাঁশি থেকে সব সুর বার করে মিশিয়ে দিলেন মাটিতে, আর চড়ে বসলেন গাছে এমন ভাবে যাতে ব্যাধের নিশানায় কোন ভুল না হয়,


শীতকালে যখন তিস্তার যৌবন থাকে না, সে সুযোগে বালির আড়ালে মিলিয়ে যায় কিশোর কিশোরি, - আর তিস্তা জলের ঘ্রান দিয়ে আগলে রাখে.....

১০
তোমার সারা শরীর জুড়ে সর্ষেফুল
কবির আর কি দোষ, অনিবার্য স্খলন

১১
বসন্তদোষে তোমার আবির ছুঁয়েছিলাম, তারপর থেকেই যাই ধরি সব রঙিন হয়ে যায়

১২
ঘন নীল আকাশ, তীব্র হলুদ সর্ষের ক্ষেত, দুদিক থেকে পরস্পর পানে স্লো মোশনে ছুটে আসছে শাহরুক আর বিদ্যা বালান, কমে আসা দুরত্বের মাঝে রেল লাইন জেগে ওঠে হঠাৎ, ছুটে আসে ট্রেন অলৌকিক, চলতেই থাকে চলতেই থাকে, চলে যেতেই থাকে

১৩

ক্রমশ কমতে থাকা দুটি ঠোঁটের দুরত্বের মাঝে লুকিয়ে ছিলো যমুনা, আর একটা নৌকা তখন রূপসী কলসিকে শোনাচ্ছিলো ঝড়ের অলীক উপাখ্যান

১৪
যেসব বরফ গতজন্মে আগুন ছিলো সেখানে ছুঁইয়ো না ঠোট -- জ্বলে যেতে পারে অভিমানি অন্তর্বাস

_____________________________
© শুভময় ভট্টাচার্য্য

।। জয়যাত্রা ।।


নিজের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকতে ঠুকতে
মহান এক যন্ত্রসঙ্গীতের জন্ম দিয়ে তার কম্পোজিশনের কাগজটাকে পলি ব্যাগে ভরে
চিরদিনের জন্য তার দম আটকে দিয়ে ছিলাম
আর শ্বাস রোধ করে মারা সেই সুরে বিতফেন ভুল করে বানিয়েছিলেন
সার্বজনীন অতি জাতীয়তাবাদী সঙ্গীত
যা কিনা শুধু মৃত ক্রীতদাসরাই গাইতে পারে তাদের গ্যাসচেম্বারে নিয়ে যাবার জন্য আনা ট্রাকে উঠানোর পরে
ভ্যাটিকানের ব্যালকনিতে আরাম কেদারায় বসে পোপ তার আই-পডে মাস্টার আব পাপেট শোনার বিরতিতে
চোখ বুলিয়ে নেয় সাদা এক মাদি শুয়োরের আততপক্ষ সর্মথন শুনানি পর্বে
যেখানে আর এক বুনো শুয়োর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কাদায় পরে গজরাতে থাকে
আর আমার শববাহী মিছিল তীব্র ঘৃণায় আমাকে ভাসিয়ে দিয়ে আসে টেমসের হাঁটু জলে
সেখানে একটা প্রজাপতি আমার কফিনের উপর বসে ভাসতে ভাসতে পৌঁছে গিয়েছিলো প্যালেস্টাইনের লাশকাটা ঘরে
আমি তখন কফিনের ভেতরে ঈশ্বর আর শয়তানের সাথে রাশিয়ান ভদকায় চুমুক দিচ্ছি
যদিও তাদের কেউই আমার ডেথ সার্টিফিকেট এমনকি বালিশের তলায় গুজে দেওয়া ধর্মগ্রন্থ নিয়ে কোন প্রশ্ন করেনি
তাদের পুরোটা সময় গিয়েছিলো ক্লাস্টার আর ড্রোনের শামুক গতি নিয়ে উপহাশ করতেই
এরপর মহামতী মোহনদাস তার নতুন শান দেওয়া ছুরি দিয়ে আমার ফুসফুস কেটে নেওয়ার পর তা টেরেসাকে দান করে শিখিয়েছিলেন অহিংসার গান
আর সুভাষ তাতে জুড়ে দিয়েছিলেন ম্যাক্সিকান স্পাইসি রেসিপি
সেই ডিনারে জন লেননও উপস্থিত ছিলেন রবিশংকরের চাদর গায়ে জড়িয়ে, ভরপেটে ইমাজিন গাইবার জন্য।
তখন দক্ষিণের কোন এক উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংলগ্ন ফুটপাতে আর্জেন্টাইন এক রক্ত বিশারদের মুখ গেঞ্জিতে একে হোমমেড বিপ্লবীরা হয়ে উঠেছিলো সফল একেকজন ব্যবসায়ী,
আর দানোবাধিকার সংরক্ষন আইনে রামের ক্ষুদ্রাংশ বনে যায় টেররিস্ট।
তখন লাশকাটা ঘরে শুয়ে পকেট ও ফুসফুসবিহীন আমি খুব আয়েশ করে নিকোটিন চুমু এঁকে দিতে থাকি শকুনির ডানায়,যে কিনা আমার মগজ খেয়ে একটা গৃহপালিত স্পিংকসে নিজেকে বদলে ফেলেছে।
__________________________
© মোহাম্মাদ সামি

।। সবুজ সবুজ ।।



(এক)

পুকুরপাড়ে বসে বসে ঘাস তুলে চিবোচ্ছিলাম।

চারপাশে প্রচুর লোকজন। কেউ – কুইন ভিক্টোরিয়া অমর রহে -  বলে চেঁচাচ্ছে, কেউ সামনের নারকেল গাছটা সাঁতরে উঠবে বলে গত চার বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাগলা গারদে যা হয়, একেবারে চিলুবিলু অবস্থা।

ঘন্টি এসে বসল আমার পাশে, রোজই বসে। ও ফিমেল ওয়ার্ডে থাকে।

ঘন্টির দিকে দুটো ঘাস এগিয়ে দিয়ে বললাম – চিবোবি?

ও হি হি করে হেসে বলল – ধুর শালা, তুই একটা পুরো ক্ষ্যাপা মাইরি…

তাইই হবে। এদিক ওদিক দেখে বললাম – এই ঘন্টি, কেক খাবি?

ঘন্টি উদাস চোখে পুকুরের জলে একটা ফড়িং – এর খেলা দেখতে দেখতে মাথা নাড়ল। আমি সকালবেলা জলখাবারের থেকে বাঁচিয়ে রাখা পাউরুটির টুকরোটা পকেট থেকে বার করে দিলাম।

ঘণ্টি সেটা মুখে দিয়ে আনমনে চিবোতে লাগাল।

আমি একটু ইতস্তত করে বললাম – কি রে কেমন লাগল বললি না?

ও বলল – ভালো, একটু সস হলে আরো জমতো।

আমি বললাম – দূর পাগলি কেক –এ কেউ সস খায় নাকি? একটু সিরাপ দিতে হয়, চকলেট সিরাপ…

 – হুঃ তুই সব জানিস!

 – আলবাত জানি, আমি অফিসে চাকরি করতাম তো, সেখানে খুব কেক কাটা হতো।

ঘণ্টি বলল – এই দেখ দেখ… ওই জলের ফোঁটাটায় রামধনু দেখা যাচ্ছে…

একটু মুখ ফিরিয়ে দেখলাম। জলের ফোঁটার রামধনু দেখতে পেলাম না, তবে ঘন্টির চোখে…

কেলো সদ্দার এসে পিছনে দাঁড়িয়েছে, সাথে টিলুরানী।

কেলো বলল – এই যে রাধাকেসটো, চলো এবার চেক আপ হবে।
টিলুরানী হি হি করে হেসে উঠল।

আমি কেলোর সাথে হাঁটা দিলাম, একবার পিছন ফিরে দেখলাম টিলুরানী ঘন্টির হাত ধরে ফিমেল ওয়ার্ডের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

(দুই)

ডাক্তারবাবু বললেন – কি রে, আজ তো তোকে বেশ ভালো দেখাচ্ছে!
মাসখানেকের মধ্যে বাড়ি যেতে পারবি তো?

দেখলাম বাবা মাও এসেছে, ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি হেসে মাথা নাড়লাম। তারপর সবার অলক্ষ্যে আস্তের উপর ডাক্তারবাবুর মোবাইলটা নিজের পাজামার কোমরের কাছে গুঁজে নিলাম। আমার চুরি করার বাতিক আছে, ক্লেপ্টোম্যানিয়া।

ডাক্তারবাবু বললেন – ঠিক আছে যা এখন। তোর বাবা মা কে সামনের মাসে তোকে নিয়ে যেতে বলে দিচ্ছি...

আমি বাবা মার কাছে গেলাম। বাবা আমার মুখে, গায়ে হাত বুলিয়ে দিল। মা আমার বুকে মাথা রেখে বলল – কত রোগা হয়ে গিয়েছিস সোনা...এবার তোকে তাড়াতাড়ি বাড়ি নিয়ে যাব...

পিছনে শুনলাম ডাক্তারবাবু বলছেন – এই আমার মোবাইলটা... কোথায় গেল? এই তো এখানে ছিল?

কেলো সদ্দার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। ক্যাঁক করে আমার গলা চেপে ধরে বলল – বার কর , বার কর শয়তান, কোথায় রেখেছিস?

একমিনিটের মধ্যেই মাল বেরোল। মা ডুকরে কেঁদে উঠল, ডাক্তারবাবু  বাবার দিকে তাকিয়ে হতাশভাবে মাথা নাড়লেন। কেলো হিড়হিড় করে আমায় টানতে টানতে ওয়ার্ডের দিকে নিয়ে চলল।

আমি একটা অফিসে চাকরি করতাম। সেখানে এমন চুরি চামারি শুরু করেছিলাম যে সবাই মিলে আমায় পুলিশে দিল। কেস হলে দেখা গেল যে আমি নাকি সাধারন অপরাধী না, মানসিক রুগি; তাই এখানে পাঠানো হলো।

এসে আলাপ হলো ঘন্টির সাথে।বাইরে থাকার সময় ওকে নাকি কেউ খুব ঠকিয়েছিল। দেহে, মনে চরম ঘা খেয়ে একসময় ও মানুষের সমাজের উপর বিশ্বাসটাই হারিয়ে ফেলে। এখানে এসেও কারুর সাথে কথা বলত না, চার পাঁচবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে।

একটু সময় লেগেছিল ঠিকই, তবে আজ আমরা বন্ধু।

সুস্থ তো আমি কবেই হয়ে গিয়েছি, কিন্তু এখন আমি চাই একটা জিনিস চুরি করতে, মাত্র আর একটা... সেটা না করে বেরোতে পারব না কোনদিন...

ওয়ার্ডের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম ঘন্টির চোখে লেগে থাকা রামধনুটা আজ বিকেলে দেখব, ঠিক দেখবই...  

সমাপ্ত
___________________________
© নীলাঞ্জন মুখার্জ্জী

।। সময় ।।



এক এক্‌টা মিনিট যেন অনন্ত সময় –
বাস স্টপে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে
এই মনে হয়...
ভুলে যাওয়া পা’য়ে—ব্যথা
আর যত ছবি, চলে যায় বাঁ থেকে ডানে
কত কথা         মনে আনে
আগামী সফর...
             এক একটা দিন
হয়ে যায় উজ্জ্বল রঙিন
                   মাছরাঙা ডানা।

দূর থেকে দেখি
নীরেন চক্রবর্তী’র কলকাতার যীশু’র মতন
টলতে টলতে ছুটে আসা –
                হাতে ব্যাগ, ফোঁটা ফোঁটা ঘাম গালে
অতঃপর        আমায় দেখালে
                           ‘সরি’-র মাইম...
যোগেশ দত্ত’ও পার্ট টাইম শিখে নিতে পারে !
                কাছাকাছি এলে, সব কিছু বলা হয়ে যায়
                 হাপরমার্কা বুক উথালে পাথালে ছায়া খুঁজে পায়...
এক এক্‌টা মিনিট তখন পলাশের ডালে বসে -
                       চেয়ে নেয় বাড়তি সময়।

নিউটন সূত্র মেনে আমাদের চলা।
বোঝাপড়া—ভালো লাগা—কথা বলা
                                      সবখানি – ।
কে কবে হারায় ?  জীবনের মানে ?
পৃথিবী তো একমুঠো ! আকাশ বাকিখানা জানে,
বোঝে। তবু মাঝে মাঝে চুপ্‌ করে যায় !
হে অনন্ত মহাকাল ?  আর বাকি          কতোটা সময় ?
কেন মাঝে মাঝে, তবু—
                      আমাদেরও,
 বোবা হয়ে যেতে হয় ??
________________________
©গৌতম দত্ত

।। ভ্যালেন্টাইন গিফ্ট ।।



সিনেমার নায়কেরা সাধারণতঃ গোঁফ রাখেনা।  পুরুষ মানুষ নাকি গোঁফ ছাড়া বেশ রোমান্টিক দেখতে লাগে।  অন্ততঃ বন্ধুরা তেমনি বলতো।  কাজেই একদিন আমারও শখ চাপলো নিজের সিরিঙ্গি চেহারায় একটু রোমান্টিক লুক দেবার। যেমন ভাবা তেমন কাজ।  দাড়ি কাটার সময়ে দিলাম গোঁফটাকে উড়িয়ে।  ভাবতেও পারিনি যে গোঁফ কেটে ফেললে মুখের চেহারা এমন পালটে যায়। আয়নায় চেয়ে দেখি , কোথায় রোমান্টিক , উলটে মুখে পুরো সখি সখি রূপ।  লজ্জায় মুখ ঢাকতে পারলে বাঁচি।  বাড়ি শুদ্ধ সবাই বলতে লাগলো - তুই কোন দুঃখে সখি সেজেছিস।  সেদিন আর বন্ধুবান্ধবদের আড্ডায় গেলামনা লজ্জায়।  দুপুরে  ঘুম থেকে উঠে দেখি নিজের মুখের নতুন চেহারা নিজের চোখে সয়ে গেছে।

সন্ধ্যাবেলা ভাবলাম নতুন চেহারা নিয়ে নীলুর সঙ্গে দেখা করে আসি।  ওর হয়তো আমার নতুন ফেসকাটিং ভালো লাগতে পারে। নীলুদের বাড়ির দরজার কড়া নাড়তেই দরজা খুললো নীলু স্বয়ং। আমাকে দেখেই  আঁতকে উঠে বলে ,' তোমাকে  আমি চিনিনা।  গোঁফ ছাড়া এবাড়িতে তোমার ঢোকা বন্ধ।  যেদিন গোঁফ গজিয়ে আগের রূপে ফিরবে সেদিন তোমাকে আমি অভ্যর্থনা করবো।  এই বলে নীলু আমার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো।  বুঝতে পারলাম নীলু আমার এই সখি সখি রূপ ওদের বাড়ির কাউকে দেখতে চায়না।
আমি তারপর সপ্তাহ খানেক নীলুদের বাড়ি যাইনি।  দাড়ি গোঁফ বাড়তে দিয়েছি।  ভেবেছিলাম দাড়ি গোঁফ বাড়িয়ে একটু বিরহ বিরহ ভাব এনে নীলুদের বাড়ি যাবো।  সপ্তাহ খানেক পরে একমুখ খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফ নিয়ে নীলুদের বাড়িতে হাজির হই।  সেদিন দরজা খুললো নীলু নিজে।  আমাকে  কিছু না বলে আঙ্গুল দেখিয়ে সোফাতে বসতে বললো। আমি বসতেই নীলু বলে , ' নিজের রূপ পালটে তুমি আমাকে কি মেসেজ দিতে চাইছো ?' আমি বলি ,' মাঝে মাঝে তো রূপ পাল্টাতে ইচ্ছে করে।' নীলু কেমন আনমনা হয়ে বলে ,' তুমি কি চাও আরো এক সপ্তাহ তোমাকে নির্বাসন দিয়ে রাখি ?' আমি কি মনে করে বলে ফেললাম , ' আমাকে নির্বাসনে পাঠালে তো তোর শান্তি।  আমার সঙ্গে বকবক করে সময় কাটাতে হয়না। '

নীলু হটাৎ চেঁচিয়ে বলে ,' তুমি কি টের পাওনা  সাতদিন যে তুমি আসোনি কে বেশি কষ্ট পেয়েছে ? তোমরা ছেলেরা এতো কম সেনসিটিভ কেন ? একটু সেনসিটিভ হলে বুঝতে পারতে আমি কি চাই। ' আমি উঠে দাঁড়িয়ে বলি , ' ঠিক আছে , আমি তাহলে দাড়িটা কমিয়ে আসি। ' নীলু উঠে এসে খপ আমার হাত ধরে টেনে টেনে নিয়ে যায় ওদের বাথরুমে আর বলে ,'  দাদার দাড়ি কাটার সব সারঞ্জাম আছে।  চুপচাপ দাড়ি কামাও। ' দেখি কখন যেন নীলুর মিনু বৌদি পাশে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে।  সেই আমার প্রথম দুই মহিলার তত্ববধানে দাড়ি কাটা।  দাড়ি কাটা শেষ হতেই দেখি নীলু একটা ছোট সেন্টের শিশি আমার হাতে দিয়ে বলে , 'এটা তোমার দাড়ি কাটার পুরস্কার। '

বলতে দ্বিধা সেটাই আমার নীলুর কাছ থেকে পাওয়া প্রথম পাওয়া গিফ্ট , আজকের দিনে যাকে বলে ভ্যালেন্টাইন গিফ্ট।
______________________________
© সনৎ মিশ্র

।। এ এক অন্য গল্প ।।



এ এক অন্য গল্প ... না দেখে না চিনে
শব্দ আখরে অনুভবে প্রতিক্ষণে
কবিতাতে শুনি তার আকুল আহ্বান
সুদূর নীহারিকা আলোকবর্ষ পার থেকে যেন
ডেকেছে আমায় নক্ষত্র এক পথহারানো !

আঙুলে ছুঁয়ে গেছে আঙুল
স্পন্দনে মিলিয়েছে হৃদ্স্পন্দন তার কিভাবে কিজানি
ঝরিয়েছে অকাল বর্ষণ .. এঁকেছে রঙধনু
ফুটিয়েছে শেফালি ফুল মুঠো মুঠো বকুল
পাপড়িখসা শুভ্র কামিনী !
প্রজ্জ্বলিত মিঠে ফাগুন আগুন - ধুনি
রাগ বাহারের মূর্ছনাসুরে দিগদিগন্তে প্রতিধ্বনি
মাতোয়ারা কিশলয় বসন্ত পবন
কস্তুরী সুরভি অগরু চূয়া চন্দন ...
চুপকথাতে পবিত্র শ্লোক উচ্চারণ !!

তাকে দেখিনি স্বপনে
পেয়েছি শুধু নিবিড়তম মননে
বিভোর নিমগ্নতায় .. এক অতীন্দ্রিয় পাওয়ায়
জানি না ; কি তার পরিচয়
অবয়বহীন সে -- ছায়া ছায়া এক মায়া
কেবলি কবিতায় সপ্রাণ
ভীষণ রকম জীবন্ত সতত ...
আমার চোখের ধ্যবড়ানো কাজলের মতো !!
আছে কি সে অন্য কোথাও ; অন্য কোনওভাবে
হয়তো অবচেতনে কিংবা অন্য কোন ভুবনে .. !!?
____________________
© সুচরিতা মুখোপাধ্যায়

।। কার্তিকের দ্বিতীয় দিনে ।।



এই ভাইফোটার দিনদুটো মানে কালীপূজোর পর প্রতিপদ আর দ্বিতীয়া এই দুদিন  ছিল আমার ‘হাই রিস্ক’ ডেজ।  জনৈকা রূপসী না , তার মা  ছিলেন সাংঘাতিক । ভালো করেই বুঝতেন যে তার বাড়িতে  আমার প্রায় প্রাত্যহিক আনাগোনা ‘মাসীমার হাতের মালপোয়া খাওয়নের জন্য’ না। ফাঁকেতালে তাঁর মেয়েটির  পাণিগ্রহণের ধান্দায় থাকার সম্ভাবনা আমার  প্রবল। মুখচোখ উচ্চতা ভালো     গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল হলেও আমার  উচ্চারণে বাঙাল টান।  রোগা,হাওয়াই চটি ,পাজামা, লংশার্ট পরণে আমাকে কোনমতেই তাঁর আধুনিকা শহুরে মেয়ের মনে ধরবে না সে ব্যাপারে নিরানব্বই ভাগ সুনিশ্চিত হওয়ার পরেও বাকী একভাগ কার্যকরী করতে তার মেয়েকে দিয়ে আমাকে ভাইফোটা দেওয়াবেনই ।

আসলেই আমার অন্যান্য বন্ধুদের মত একজন প্রেমিকা জোগাড় করতে না পেরে জীবনটা যে আমার সাহারা হয়ে যাচ্ছে এ ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ ছিলাম।বন্ধুদের কাছে ‘ধূর’ বলে আমি পরিচিত ছিলাম।  মেয়েদের কাছেও বোধহয ‘কেবলুশ হাঁদারাম’।        ‘গ্রহণীয় ভ্রাতার’ থেকে যে ‘প্রেমপ্রস্তাব দেওয়ার পর প্রত্যাখ্যাত’ যুবক অনেক বেশী শ্রেয় এ নিয়েও আমার কোন সন্দেহ ছিল না। কাজে কাজেই  ঐ মেযের মাএর  তার মেযের কাছথেকে ভাইফোটা নেওয়ার প্রস্তাব প্রতিবারই আমি অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে প্রায় মেসির কায়দায় ডজ্ করে এড়িয়ে যেতাম।মেয়েটিও কেমন যেন মনে হতো এ ব্যাপারে একদমই উৎসাহী না। কি জানি এলেবেলে আমাকে কি দাদার আসনে বসানোরও যোগ্য মনে করতো না?

     প্রতিপদ পড়তে না পড়তেই আমার একমাত্র বোন জয়িতাকে ঘড়ি ধরে দু ঘন্টা সময় দিযে                বলতাম,“ একমাত্র দাদাকে ফোটা দিয়ে যমদূয়ারে কাঁটা ফেলবি কি না সেটা তোর ব্যাপার। তবে দু ঘন্টার পর আমার ধনু রাশির অমৃত যোগ কিন্তু শেষ।”  দাদাঅন্ত প্রাণ আমার বেচারা বোনটা দু ঘন্টার আগেই শিশির কাজল ঘি আরো কিসব মিশিয়ে দাদাকে ফোটা দিয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াত।  আমি “ অয়ি ভগিনী ! তিষ্ঠ খনকাল।”বলে লম্বা শার্টের ঝোলা পকেট থেকে দু প্যাকেট মশলাচিড়া(আমার বোনের সবচেয়ে প্রিয় খাবার) বার করে হাতে গুঁজে দিয়ে,“ লহ! লহ! ভক্তিভরে চর্বন কর তব অক্ষম জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার এই মশলাচিড়ার স্নেহাশিষ।“ পিছন থেকে বোন,“দাদা দাদা! তক্তি নাড়ু নারকোলের সন্দেশ এত কষ্ট করে আমি আর মা কালরাতে বানালাম । মুখে দিয়ে যা!”  আমি  “ ফিরে এসে তৃতীয়ার দিন ” বলে তখন স্টেশনের রাস্তায় দৌড়াচ্ছি।  সোজা ট্রেন ধরে কালনায় পিসির বাড়ি। সেখানে আমার পিসির পাঁচ মেয়ে,কোন ছেলে নেই। মহা সমাদরে পাঁচবোনের দেওয়া ফোটা নিয়ে গাঁয়ের মাছ দুধ খেযে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন আকাশে তৃতীয়ার ক্ষীণ চাঁদ উঠে গেছে। ভাইফোটার আবহাওয়া গজব হয়ে গেছে। কিন্তু ভবী ভোলবার না।

 যাকে ঘিরে এই কাহিনী সেই সুতপা ছিল ঐ এলাকার সবচেয়ে  সুন্দরী মেয়ে। তার পিছনে অনেক আচ্ছা আচ্ছা ছেলেরা পড়ে আছে। কিন্তু এই মেয়েটি ছিল যাকে বলে অসম্ভব রিজার্ভড। তার অপরূপ চোখ দুটো কোন ছেলের মাত্রাছাড়া কোন আচরণ দেখলেই কি করে যে অমন ঠান্ডা চাউনি নিক্ষেপ করত! তাবড় তাবড় বখাটে ছেলেও তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সম্ভ্রমে মাথা নীচু করে ফেলত। প্রেম নিবেদন করতে গিয়ে তো তো করে ফিরে আসতো। ছেলেমহলে তার নামই ছিল ‘সাধ্বী সুতপা’।
এদিকে আমার প্রণয়নীতি ছিল খুবই সুদৃঢ়। সেই যে আছে ‘মারি তে গন্ডার লুটি তো ভান্ডার’।  যতই প্রেমিকার অভাবে জীবন মরুভূমি হয়ে যাক হয় সুতপাকে  আমার প্রেমিকা বানাবো।  না হলে কেউই না।
সকাল থেকে রাত অবধি সস্তার টিউশন দেওয়া , খাওয়া  শোয়া, ঘুম তারপরও দেড় দু ঘন্টা যেটুকু সময় যেদিন বাঁচাতে পারি সুতপার বাড়িতে গিয়ে পড়ে থাকা।
‘কান টানলে মাথা আসবে’ এই আপ্তবাক্য মনে রেখে  সুতপার মায়ের ফুটফরমাইশ খেটে সুতপার মন পাওযার চেষ্টা।  যেমন সুতপার মা বললেন,“মন(আমার ডাকনাম) এই তর আওনের হময় (সময়)! আমরা মা বিডি দুইটা মুড়িই খাই হন্ধ্যায়। তয় শুকনা মুড়ি। যা না বাজারে গিয়া দাঁড়াইয়া থাইকা গরম দুইখান  ফুলুরি ভাজাইয়া লইয়া আয়।”  কিংবা,“ এই বাজারে বালা(ভালো) জীয়ল মাছ উডে নাই। যা একটু বাগুইহাটি থন তর বইনের জন্য দৌড়াইয়া গিয়া মাছ লইয়া আয়।” লক্ষণীয় ভাবে আমি মনেমনে সুতপাকে যতই আমার মানসী ঠাওরাই সুতপার মা সুতপা সম্বন্ধে আমায় কিছু বলতে হলেই ‘তর বইন’ ছাড়া বলতেন না। এমনকি ‘তরা কইথে গেলে মায়ের প্যাডের ভাই বইনই।দুয়োজনেই বাপরে খাইছস।  আমি ত’ বুঝি তর কাছে জয়িতা আর সুতপার কুন পাইরথক্যই নাই।” আমার নীরবতাই তিনি সম্মতি বলে ধরে নেন। সুতপা কি ভাবে বোঝার উপায় নেই।তবে আমি ভাবতেই থাকি ‘বিধি ডাগর আখি যদি দিয়েছিলে সে কি আমার পানে ভুলে ফিরিবে না?” সে আমার দিকে তেমনভাবে চোখ তুলেও তাকায় না        
যাইহোক সেই তৃতীয়ার রাত। ভাইফোটার রেশ আর কিছু নেই। তবুও সুতপার মা আমাকে দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন,“ মন! কুথায় ছিলি বাপ? তর বইন তরে ভাইফুডা দিব কইরা পতিপদ দ্বিতীয়া দুইয়ো দিন উপাস দিল। ল বইয়া পড়। তপা(সুতপার ডাক নাম) ফুডা দেওয়নের কাজল চন্দন লইয়া আয়। অখন আত(রাত) শিশির দৈ এ কাম নাই। শাঁখে ফুঁ দিয়া জুকার(জোকার) দিয়া কাম সার।”
আমি মিনমিনে স্বরে বলি,“কিন্তু এখন ভরা তৃতীয়া। ফোটা তো হয় না। ” তিনি বলেন,“আমরা হইলাম সিলেটি বারেন্দ্র বাওঁন।আমাগো তিতীয়াতে(তৃতীয়া)ও বাইফুডা  দ্যায়ন যায়। আয় তপা সব দইব্য(দ্রব্য) লইয়া            আয়।“      
মেয়ে ডাকাডাকিতেও বেরোচ্ছে না দেখে মা নিজেই মেয়েকে নিয়ে আসতে ভিতরের ঘরে ঢুকে গেলেন।  একটু পরই মা মেয়ের প্রথমে ফিসফিস  তারপর কিছুটা উচ্চস্বরেই তপ্ত কথোপকথন  আমার কানের ‘ভিতর ‘দিয়া একেবারে মরমে’ প্রবেশ করল।    
যথাঃ----          মা,“আরে ছেরি!তরে  বারম্বার কইতাছি বালায় বালায় ছেমরাডারে বাইফুডাটা দিয়া ল। তুই আমার প্যাডের(পেটের )মাইয়া তর বালার জন্যই কই। অয়ের রকসকম আমার কেমন কেমন যেন লাগে। তরে আড়ে আড়ে দ্যাহে(আড় চোখে দ্যাখে)। তর  বাপে ত' মরছে। অখন মায়ে বিডি(মা মেযে) থাহি। তয় বেকার পুলা কাম কাইয্য তেমন নাই। কথা কইলে হুনে(শোনে)। মুখছাট নাই। ”       মেয়ে,“ও গরীবের ছেলে। ভূলে গেছ হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষায় পাড়ার ভাঙা স্কুল থেকে সপ্তম হয়েছিল। পয়সার অভাবে অনার্স পাশ করে বসে গেছে। টিউশন দিয়ে পরিবার চালায়। আজকাল কেমন ভ্যাবলা ভ্যাবলাও হয়ে গেছে। পাছে তোমার সুন্দরী মেয়ে ওর প্রেমে ফেঁসে যায় তাই এই প্রতিবার' ফুডা দে ফুভা দে' কর। আর ঐ চৌধুরীদের থার্ড ডিভিসনে পাশ করা ছোট ভাইটা। একটা লোফার। আমার দিকে রাস্তায় ঘাটে ইতরের মত তাকায়। যেহেতু ওরা কোটিপতি ব্যবসায়ী  ও  বাড়িতে এলে এই তুমিই আহ্লাদে গলে পড়। ”             মা,“ আরে আমি তর প্যাটে হইছি না তুই আমার?
এ দেহি(দেখি) বলদার বলদা । তয় গিয়া কয় চানদে আর কিযেতে। চৌধুরীরা হইল গিয়া রাজা। তয় গিয়া রাজপূত্র নিজে মিষ্ট হাতে লইয়া হাঁইট্যা বাড়িতে  আইল। অথিত মানুষ  কোথায় তারে বওয়াবি চা জল দিয়া আপ্যয়ন করবি। তা না গুমোর দেখাইযা রান্নাঘর গিযা বইয়া রইল। কত অপমান হইল ছি ছি ছি। ”        
মেয়ে,“ তাই না কি! ওকে পারলে আমি জুতো পেটা করতাম। রাস্তায় আমায় আঙুল দিয়ে দেখিয়ে  বলে ’এক রাতের জন্য হলেও আমার চাই। ’  ভেবেছে আমরা গরীব প্রতিবাদ করা দূরস্থান পয়সা পেলে ওর লালসার কাছে বিকিয়ে
যাবো। ”          মা,“এঃ! কথা কছ (বলিস)যেন বায়োসকোপের ফুলকুমারী। যা অহনে ওই ছ্যামড়ারে(ছেলে) ফুডা দিয়া বিদায় দে। কাইল আওনের সময় একখান ছানের(স্নানের) মগ আর পাকা একখান বেল য্যান লইয়া আহে।“    
 মেয়ে ,“ শোন মা আর একবারও যদি ঐ ফোটা ফোটা দে কর তবে শুনে রাখ। মন দিয়ে শুনে রাখ। আজ পর্যন্ত কেউ জানে না এমনকি যাকে নিয়ে আমার স্বপ্ন ঐ বাইরে কাচুমাচু হয়ে বসে আছে ঐ মানব রায়ও(আমার ভালো নাম) না।কিন্তু  শুধু ও জানবে বা তুমি জানবে তা হবে না জোরে জোরে  চীত্কার করে  মন্ত্র বলব গোটা পাড়ার লোকই শুনতে পাবে। আমি যদি ওকে ফোটা দি  তবে ভাইফোটা না। নতুন এক ধরণের ফোটা দেখতে পাবে ‘স্বামী ফোটা।’ মন্ত্রটাও খুব সোজা করে তৈরী করে নিয়েছি। শোন ,‘পতির কপালে দিলাম ফোটা।  যমদুযারে পড়ল কাঁটা ।দেখলো আমার বুকের পাটা। পতি আমার নিমতিতা। উমার হাতের ফোটা পাইয়া শিব যেমন অমর  সুতপা সান্যালের হাতের ফোটা পাইয়া তার পতি মানব রায়ও তেমন অমর। ”  

মাযের সক্রন্দন সংলাপ ,“ তুই আমার প্যাডের(পেটের) ছাঁও(ছানা) হইয়া আমারেই খাবি!গেছি রে গেছি।” কাণে যেতেই আমি ছিটকে বেরিয়ে আসি কেন না স্বপ্নলোকের চাবি আমি পেয়ে গেছি। পালকের মত হাল্কা শরীর নিয়ে ভাসতে ভাসতে বাড়ি পৌঁছোই।  সে দিনের তারিখটা আমার চিরদিনই মনে থাকবে ---দোসরা  কার্তিক

              সুতপা তখন রবীন্দ্রভারতীতে ইংরেজিতে এমএ পড়ে। পরের দিন টিউশন কামাই করে আমি গুটিগুটি পায়ে দশটা না বাজতেই সুতপার অপেক্ষায় উনিভারসিটির গেটে দাঁড়িয়ে আছি। দশটার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে বাস থেকে নেমে ধীর পায়ে সুতপা আমার দিকে এগিয়ে এলো। যেন আমি ওখানে না দাঁড়িয়ে থাকলেই ও অবাক হতো।  বলল,“ঐ উল্টোদিকের গলিটার শেষে একটা পার্ক আছে। ওখানে গিয়ে বসুন। দু ঘন্টা পর আমার অফ আছে। আমি তখনই যা বলার বলব। ”      

আমার জীবনের প্রথম রোমান্সের দিন। বুক ধড়াস ধড়াস করছে এবং সুতপা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ,” তুমি মানব রায় হায়ার সেকেন্ডারিতে প্রথম দশে ছিলে। কিন্তু বাঘটা খাঁচা থেকে একবারই বেরিয়েছিল। আর  দেখা যায় নি। এখন তুমি দারিদ্র্যের বিজ্ঞাপন হয়ে ঘুরে বেড়াও। বেশ জানো দেখতে ভালো আর পুরনো ভালো ছাত্রের ইমেজ নিয়ে এখনও কিছুদিন বাজারে চলে যাবে। ” আমি তো তো করতে থাকি। ও একতরফা বলে চলে,“দারিদ্র তোমার ভূষণ তোমার গ্ল্যামার তাই না? সকাল থেকে সন্ধ্যা শস্তার টিউশন। বাকী সময় আমাদের বাড়িতে হ্যাংলার মত পড়ে থেকে আমার মায়ের মনোরঞ্জন কর। আজ কয়েতবেল কাল ডাইজিন। ভাবো আমি ভীষণ  ভীষণ খুশি  হচ্ছি। তোষামুদেদের আমি কেন কোনো মেয়েই পছন্দ করে না। একসময় ভালো  গল্প কবিতা লিখতে। সে সবও গেছে তোমার। জয়তী আমারই বয়সী। তার বিয়ে কি ভাবে দেবে তাও ভেবে দেখ না। তোমায় আমি পরিষ্কার বলে দিচ্ছি আমার ব্যাপারে তুমি যদি সত্যিই সিরিয়াস হও আগামী এক বছরের মধ্যে তোমার যোগ্য চাকরী  যোগাড় করবে আর তার ছ মাসের মধ্যে জয়তীর বিয়ে দেবে। আমি জানি তুমি চাইলে বাঘটা আবার খাঁচা ছেড়ে বেরোতে পারে এখনও। আর হ্যা আগামী দু বছর তুমি আমাদের বাড়ি যাবে না। এক পাড়ায় যখন থাকি রাস্তাঘাটে  মাঝেসাঝে যা দেখা হবে তাতেই হবে। আগামী  দু বছর আমি তোমারই থাকব।”আমি কোনোমতে বললাম,“আর তারপর?” তপা এগিয়ে যেতে যেতে বলল,“আগামী দু বছরের কথাই ভাবো।“ আমি উঠে দাঁড়ালাম।  

                টাই খুলতে খুলতে ভাবছিলাম। জীবনের অনেকটা পথ হেঁটে এলাম। আজ আমার অবসরের দিন ছিল। আমি কথা রেখেছিলাম। প্রথমবার পরীক্ষা দিয়েই সবচেয়ে সম্মানিত সর্বভারতীয় চাকরীতে নির্বাচিত হই। তার ছমাসের মধ্যে আমার বোন জয়তীর বিয়ে দি। সুতপা আমার ছত্রিশ বছরের বিবাহিতা স্ত্রী আমার কৃতী কন্যার জননী ।

আমার বিয়ের এক বছরের মাথায় আমার ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হয়। একই সময় আমার মায়ের নিমোনিয়া কাপলড উইথ টাইফয়েড হয়। আমার  শাশুড়ী মা মানে সুতপার মা তিনরাত টানা জেগে দিনরাত সেবা করে আমাকে আমার মাকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিযে এনেছিলেন। আমার মা তাঁর হাত ধরে বলেছিলেন,“ আগের জন্মে তুমি আমার মায়ের পেটের বোন ছিলে।“  এইলোকের উপর কি রাগ করে থাকা যায়? অভাবে মানুষের স্বভাবের  ক্ষয় হয়। কিন্তু ভিতরের মানুষটা হারায় না। সময়মতো ঠিক বেরিয়ে আসে।

________________________
© পৃথ্বী ব্যানার্জী 

।। ভাঙন ।।


       
ভেঙে পড়ছে সব মাথার উপর
তুমি ভাঙছো,তোমার প্রেম ভাঙছে
আসলে যা মূঢ় হৃদয়ের কপটতা
ভাঙছে স্মৃতি,বুকের ভেতর লুকায়িত
অনেকটা ঝিনুকের মুক্তোর মতো
একান্ত গোপনে সযত্নে ঢেকেঁ রাখা

ভাঙছে কবিতা ও তার অন্তর্গত আবেগ
ঠাসবুননে গাথা উজ্জ্বল শব্দমালা
সম্পর্ক ভাঙছে যা কিছু ছিল
মেকি,পোষাকী কিংবা অন্তঃসারশূন্য
ভাঙছে মিথ্যে,খোলস ছেড়ে বেরোচ্ছে
সত্য আলোকিত ভোরের অনুরূপ

ভাঙন সব সময় মন্দ নয়
দেয় সে অনিবার্য সত্য,পরম স্বস্তি
এবং আরেকটি সম্ভাবনাময় নবজীবন !
_______________________
© জিসান জিবরান

।। প্রণয়োপহার ।।



                         " তেতো কথাটা আগেভাগে সেরে নিতে চাই। আমার সঙ্গে সারাজীবন কাটাতে হলে আমার ধর্ম গ্রহণ করতে হবে এবং সেইমত সমস্ত আচরণ করতে হবে। আমার গরীবের ঘরে মানিয়ে গুছিয়ে চলতে হবে। বড়লোক বাবার কাছ থেকে কানাকড়িটিও নেওয়া চলবে না। "    
        এক বছর আগে প্রোপোজ ডে তে রাজন্যার প্রেম নিবেদনের উত্তরে ঘাড় শক্ত করে বলেছিল বসির।
          রাজন্যা তাতেই রাজি হয়ে গিয়েছিল। রোজ ডে র গভীর রাতে পানশালা থেকে একা বাড়ি ফেরার পথে দুই মাতালের খপ্পর থেকে প্রাণ হাতে নিয়ে রাজন্যার সম্মান রক্ষা করেছিল যে অটোওয়ালা,সেই বসির আহমেদকেই সমস্ত মন সঁপেছিল সে। এক কাপড়ে বাবার আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে এসে মসজিদে কলমা পড়ে পরভিন সুলতানা হওয়ার পর সেখানেই কাজীর কাছে নিকাহ পড়ে বসিরের সঙ্গে তার বস্তিবাড়ির ভাঙাচোরা ঘরে এসে উঠেছিল।  ভ্যালেন্টাইনস ডে র সন্ধ্যায়।
        এখানে জীবনযাপনে আগের মত আরাম নেই। নেই আগের বন্ধুবান্ধব। নেই ছুতোনাতায় হরেক উদযাপনের বাহানা। মেয়েমানুষের ঘরের চৌহদ্দির বাইরে পা দেওয়া মানা।এখানে জীবনযাপন খুব কঠোর। ডিজাইনার ড্রেস এখানে চলে না। দু চোখ ছাড়া আপাদমস্তক কালো পোশাকে ঢেকে রাখতে হয়। কাজের মাসি, রান্নার লোক এখানে অলীক স্বপ্ন। সংসারের যাবতীয় কাজ নিজের হাতে।
        এক বছরে অনেকটাই গা সওয়া হয়ে গেছে রাজন্যার। মানুষটা মোটের ওপর ভালোই। যথেষ্ট গোছানো আর সংসারী।  স্বল্প আয়ে সংসার ভালোই চালায়। মোটা ভাত কাপড়ের অভাব হয় না।
         আজ আর একটা ভ্যালেন্টাইনস ডে। ঘরের সামনে রাস্তায় সরকারী জলের কলে বাসন মাজতে মাজতে উদাস হয়ে পড়ল রাজন্যা। আগের বছরগুলোয় সুন্দরী রাজন্যার কৃপাপ্রার্থী যুবকদের দেওয়া উপহারের স্তুপ হয়ে যেত। চকলেট, টেডি, এমনতর গুচ্ছের হাবিজাবি। রাজন্যা ফিরেও তাকাতো না। বিলিয়ে দিত কাজের আর রান্নার মাসির মেয়েদের। এ বছর ও ওর ভালোবাসার মানুষ হয়ত পেয়েছ। কিন্তু সে মানুষ এতই কেজো যে বিশেষ দিনে প্রিয়জনকে উপহার দেওয়াকে হয়ত পাগলামি বলে মনে করে। শুকনো মুখে বাসনের পাঁজা নিয়ে ভিজে কলতলা থেকে জল পায়ে ঘরের দিকে এগোয় রাজন্যা।
         "  পরভীন এক মিনিট ঘরে এসো। খুব জরুরী কথা আছে।" অটোটা সাইড করে বলল বসির।
এমন অসময়ে ঘরে আসে না সে। কি ব্যাপার! রাজন্যা পড়ি কি মরি করে ঘরে এল।
            " এগুলো পায়ে দিয়ে দেখো তো সাইজ ঠিক আছে কি না।"
প্যাকেট থেকে দু জোড়া হাওয়াই চটি বের করে বলল বসির।
            " হঠাৎ!" অবাক গলায় জানতে চাইল রাজন্যা।
             " হঠাৎ কেন হবে? আজ তো ভ্যালেনটাইনস ডে। আমাদের লাইনের সবাই যে যার মানুষের জন্য গিফট কিনছে।" খুশি খুশি গলায় বলল বসির।
            "বিয়ের আগে শোওয়ার ঘরেও পায়ে চটি গলিয়ে থাকতে, বলছিলে সে দিন। পা দুটো তোমার চট করে ঠান্ডা হয়ে যায়। এখানে তো জলে জলে কত কাজ করতে হয়। ঘরের মাটির মেঝে থেকেও ঠান্ডা ওঠে। তাই তোমার জন্য এই চটি দু জোড়া কিনলাম। একটা ঘরের, একটা বাইরের জন্য। কথাটা আগে জানলে আরও আগেই দিতে পারতাম। যাক গে। হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনস ডে। আমি চললাম অটোস্ট্যান্ডের লাইনে।"
      এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই অটোয় স্টার্ট দিয়ে চোখের নিমেষে ধাঁ হয়ে গেল বসির।
_____________________________
© শর্মিষ্ঠা নাহা

।। মেয়ে আমার ।।

আজ মেয়েকে আমার মিষ্টি লাগছে ভারী
প্রসাধনে শুধু অল্প প্রলেপ,পরনে নীলচে শাড়ি
ওকে দেখতে এসেছে যারা
দলে তারা বেশ ভারি।
টেবিলে সাজানো কাঁচের প্লেটেতে
নামী দোকানের খাবার
ফেলা ছড়া করে চলছে এখন
তাচ্ছিল‍্যের আহার
এবার পায়েশটা খান,
মেয়েই রেঁধেছে অনেক যত্ন করে
উৎকন্ঠায় গিন্নির দেখি
গলাটাই গেছে ধরে
খাওয়া শেষ হলো, শুরু হলো কথা,শুধুই প্রশ্নবান
লাজে নত মুখ মেয়েটি আমার হয় বুঝি হয়রান
একটু হাঁটোতো মা,
দেখিতো তোমার হাতের লেখাটি কেমন
গানটা একটু গলা ছেড়ে গাও
লাগছে না ভালো তেমন
উচ্ছিষ্টতে ভরে আছে প্লেট, আ্যসষ্ট্রেতে ভরা ছাই
করজোরে বলি, দেখবেন, যেন খবর একটা পাই।
আমায় একলা পেয়েই মেয়ে বলে
বাবা, চিন্তা কিসের জন‍্য
লেখা পড়া শিখে এখন তো আমি
হয়েছি ভালোই পন‍্য
অসম্মানের যন্ত্রণা বুকে, মুখে ব‍্যাঙ্গের হাসি
খোঁপায় জড়ানো ফুলটা কখন শুকিয়ে হয়েছে বাসি।
_______________________
© কুনাল ভট্টাচার্য্য

।। ছিঁচকে ধর্ষক ।।


দৃশ্য --1
********
শ্রীমতি সুপ্রিয়া মন্ডল , বয়স 37, দুই বাচ্চার মা , ছোট টিকে কাজের মেয়ের কোলে দিয়ে , নিজে বড় মেয়েটির হাত ধরে বাজারে বেড়িয়েছেন । চৌমাথার কাছে এসে দেখলেন ট্র্যাফিক পুলিশের সঙ্গে দুজন সাধারণ পুলিশও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাগজের প্যাকেট থেকে ঝালমুড়ি খাচ্ছে সেদিন । সুপ্রিয়া দেবী নিজের পরিবার কে সামলে ধীর পায়ে নির্ধারিত দোকানের দিকে এগোচ্ছিলেন । উল্টো দিক  থেকে একটা ছিঁচকে আসছিলো । হাত দশ -বারো দূরত্ব যখন তখন হঠাত্ সে পকেট থেকে খৈনির ডিবা বের করল । একটু খৈনি হাতে নিয়ে টিপতে টিপতে এগিয়ে আসছে । সুপ্রিয়া দেবীর পাশ দিয়ে পার হবার সময় ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে খৈনি টিপতে টিপতে তর্জনী টি বাড়িয়ে দিল সুপ্রিয়ার বুক লক্ষ্য করে । আড়চোখে ছিঁচকের দিকে তাকাতেই অসহনীয় অশ্লীল একটি ইঙ্গিত ! পুলিশ গুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করতে করতে ঝালমুড়ি খেতে লাগল । সুপ্রিয়ার মনে হল ওদের হাত থেকে মুড়ি কেড়ে নিয়ে চুড়ি ধরিয়ে দিয়ে আসে ! কিন্তু ওসব করতে গেলেই তো লোক জানাজানি হবে ! অগত্যা.......

দৃশ্য --2
********
শহরের একটি নামকরা চারতলা সরকারি হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে ভর্তি রয়েছেন শ্রীমতি গীতা চ্যাটার্জি । গত কাল তাঁর একটি ফুটফুটে ছেলে জন্মেছে । পাশের বেডে একজন পাঞ্জাবি ভদ্রমহিলা রয়েছেন । তাঁর একটি মেয়ে হয়েছে । আজ সকাল থেকে দুই সদ্য মায়ের মধ্যে বেশ ভাব জমে উঠেছে । কাল রাত টা তো প্রায় অচৈতন্য অবস্থাতেই কেটেছে দুজনেরই । সন্ধ্যে 8 টার সময় রাতের খাবার খেয়ে দুজনে গল্প করছিল । এমন সময় জানালার বাইরে একটি ছিঁচকের আবির্ভাব । সাদা হাফ হাতা টি সার্ট ও সাদা প্যান্ট পরা 25-30 বছরের একটি ছিঁচকে । নিজের প্যান্ট ও শর্টস প্রায় হাঁটু পর্যন্ত নামিয়ে রীতিমত হস্তমৈথুনের  কেরামতি শুরু করেছে ! সঙ্গে মুখে চোখে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি । প্রসূতি বিভাগের ওই ওয়ার্ডের 6টি বেডের সদ্য মা আর হবু মায়েরা পরিস্থিতির আকস্মিকতায় বাক্যহারা.... কিংকর্তব্যবিমূঢ় !! একজন শুধু আমতা আমতা করে বলতে পারল ------গেটের দুজন গার্ডকে টপকে ছিঁচকে টা এইখান পর্যন্ত এল কি করে ?............

দৃশ্য --3
********
কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সুমনা। রোজই বাসে- ট্রেনে যাতায়াত করে কলেজ করতে হয়। রোজই কিছু না কিছু অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু আজ যা হল তা আর কহতব্য নয়। দেরি হয়ে গেছে বলে একটা ভিড় বাসেই চেপে পড়েছিল সে। বসার জায়গা তো দুরস্থান ঠিকঠাক দাঁড়ানোও যাচ্ছিল না বাসটাতে। তার মধ্যেই দুটো সিটের মাঝখানে মাথার ওপরের রডটা ধরে দাঁড়িয়েছিল সে। কিছুক্ষণ ধরেই একটি হাত তার হাতের ওপর এসে হাত সমেত রড টাকে চেপে চেপে ধরছিল। প্রচন্ড ভিড়ের জন্য ব্যাপারটাকে আলাদা করে গুরুত্ব দেয় নি সে। কিন্তু এবার সেই হাতের মালিক একেবারে তার পেছনে গা ঘেঁষে এসে দাঁড়াল। তারপর শুরু হল ছিঁচকেমি। হাতে হাত ঘষা, কাঁধে মুখ ঘষা, পিঠে বুক ঘষা এমনকি সুমনার পশ্চাত্দেশে পুরুষাঙ্গ ঘষাও শুরু হল।সুমনার গা গুলিয়ে উঠল। কান -মাথা গরম হয়ে গেল।চট করে পাশের সিটের কাছে সরে যেতে গেল। কিন্তু ততক্ষনে সেই ছিঁচকে দুই হাতে দুটো সিটের রড ধরে তাকে বেরিকেডের মত ঘিরে ফেলেছে। ভিড়ে অন্য কোন যাত্রি ব্যাপারটাকে লক্ষ্যও করেনি। কাঁধে ছিঁচকের গরম নিঃশ্বাসের ফোঁসফোঁসানিতে পরিস্থিতি আরো অসহ্য হয়ে উঠল। অতঃপর সুমনা সামনের স্টপেজ আসতেই , দাঁড়ান , আমি নামব ----- বলে দরজার দিকে ছুটল এবং কলেজের প্রায় ছয়টা স্টপেজ আগেই বাস থেকে নেমে পড়ে রেহাই পেল !...........

দৃশ্য --4
********
শহরের একটি গার্লস  ইস্কুলের ক্লাস এইটের ছাত্রী রূপা। টিফিনের সময় মাঠে বান্ধবীদের সঙ্গে খেলা গল্প করছে। মাঠের মাঝখানটাতে খুব ভিড় থাকায় ওরা একটু ধারের দিকে গিয়ে বসেছিল। যেখানে ওরা বসেছিল সেখান থেকে 5-7 ফুট দূরে স্কুলের বাউন্ডারি পাঁচিল। সেই পাঁচিলেরই খানিকটা অংশ গোল করে ভাঙ্গা রয়েছে যাতে একজন মানুষ মাথা ঝুঁকিয়ে পার হতে পারে। অনেক ছাত্রীই ছুটির সময় বড় গেট দিয়ে না বেরিয়ে পাঁচিলের ওই ভাঙ্গা অংশটা দিয়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু ওরা কেউই ভাবতে পারেনি ওদের সুবিধার্থে তৈরি ঐ ভাঙ্গা অংশটার জন্য আজকে এতবড় একটা কুরুচিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। গল্প করতে করতে রূপারা দেখল একটি মাঝবয়সী ছেলে নিজের সাইকেলটাকে টেনে টেনে মাথা নিচু করে খুব কষ্ট করে পাঁচিলের ভেতরে ঢুকছে। ওরাও কিছু বুঝতে না পেরে চুপচাপ তাকিয়ে আছে। ভেতরে ঢুকে ছেলেটি কিন্তু আর এগিয়ে এল না। সাইকেলটাকে স্ট্যান্ড করে দাঁড়াল , তারপর নাগাড়ে উড়ো চুমু ছুড়তে শুরু করল রূপাদের দিকে! রূপারা ততক্ষনে হকচকিয়ে গেছে, উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে সবাই। হঠাত্ ছেলেটা বাম হাত দিয়ে প্যান্টের চেন খুলতে লাগল আর ডান হাত দিয়ে অশ্লীল ভঙ্গি করে রূপাদেরকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে লাগল ! একটি ছেলের ঐ রকম অসভ্যতামীতে দশ-বারো জন মেয়ের একটা দল এত ঘাবড়ে গেল যে তারা সবাই ছুটতে শুরু করল ক্লাসরুমের দিকে! ছেলেটিও যথারীতি পাঁচিলের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে বেরিয়ে হাওয়া......

দৃশ্য --5
********
গোপারা আজ খুব খুশি। তাদের প্রিয় গায়কের অনুষ্ঠান আজ। অনেক কষ্ট করে দাদা টিকিট গুলো জোগাড় করে দিয়েছে। সঙ্গে এক বান্ধবীর মাও যাচ্ছে তাই কারুর বাড়ি থেকে আর আপত্তি ওঠেনি। কিন্তু বিপত্তি হল অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে! ফরাসের টিকিটে ওদের পাশেই একদল  ছেলে বসেছে। এবং অনেকক্ষণ ধরেই রীতিমত উত্ত্যক্ত করে চলেছে। প্রথমে ওরা ব্যাপারটাকে সহজ ভাবে নিয়ে কোন উত্তর করেনি। কিন্তু ওদের কাছে পাত্তা না পেয়ে ছেলেগুলো যেন বেপরোয়া হয়ে উঠল। আর শুধু হাসি তামাশা নয় ; রীতিমত অশ্রাব্য গালিগালাজ শুরু করল। গোপাদের সঙ্গে যাওয়া কাকিমা আর সহ্য করতে না পেরে ছেলেগুলোকে বললেন , তোমাদের বাড়িতে কি মা বোন নেই ?...উল্টো দিক থেকে জবাব এল , সবই আছে শাশুড়ি মা , শুধু বৌটাই নেই !..অগত্যা কাকিমা চুপ করে বসে পড়লেন এবং তার কিছুক্ষণ পরেই অনুষ্ঠান শেষ হল। গেট দিয়ে বেরোনোর সময় গোপারা কেউ লক্ষ্যই করেনি যে সেই ছেলের দলও ঠেলাঠেলি করে তাদের সঙ্গেই বাইরে বেরাচ্ছে। হঠাত্ একটি ছেলে দুই হাত দিয়ে সজোরে গোপার দুই বক্ষ মুচড়ে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল! যন্ত্রণায় গোপা 'মাগো ' বলে মাটিতে বসে পড়ল ! কাকিমা ছুটে এলেন........

নিষ্কাশ-- 1
*********
     -----এইভাবে যদি নম্বর দিয়ে উল্লেখ করতে থাকি তাহলে একসময় হয়ত নম্বর শেষ হয়ে যাবে কিন্তু ঘটনা শেষ হবে না। ছোটবেলায় বাবার কাছে একটা ছিঁচকে চোরের গল্প শুনে খুব মজা লেগেছিল। ছিঁচকে মানে জিগ্গেস করাতে বাবা বলেছিলেন, ছিঁচকে হল তারা যারা বড় কিছু করতে পারেনা,ছোট ছোট কাজ করে বড় কাজের আশ মেটায়। বড় চুরি করতে পারছে না ছোট চুরি করছে তাই সে ছিঁচকে চোর। তা --- চোর যদি ছিঁচকে হতে পারে তাহলে তো আরো অনেক কিছু ছিঁচকে হতে পারে। যেমন -- ছিঁচকে খুনি, ছিঁচকে মাতাল, বা ছিঁচকে ধর্ষক! একটি মেয়েকে শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে পাওয়া বা একজন মহিলার সঙ্গে সহবাস করার মত পূর্ণতা হয়ত তাদের মধ্যে নেই। অথবা অতটা সময় নেই। তাই যা পাওয়া যায় তাতেই লাভ। সম্পূর্ণ জামাকাপড়ে আচ্ছাদিত একজন মহিলার নগ্ন শরীরটা তারা কল্পনা করে ফেলে, এবং সেই শরীরের ওপর তার লালসাকে আর আটকাতে পারে না। আর তখনই শুরু করে ছিঁচকেমি।
    মানুষের একটি সহজাত স্বভাব আছে -- সুন্দরকে সব সময় নিজের মনে করা। নারী শরীর বড় সুন্দর,তাই তার ওপর লোভ মানুষের চিরকালের। আবার মানুষের আরো একটি সহজাত স্বভাব আছে---- তা হল সুন্দরকে নষ্ট করা, অসুন্দর করা। যে সুন্দর জিনিসটা আমার নয় সেটা যেন আর সুন্দর না থাকে। চেনা মেয়েকে পাবনা তাহলে তার মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারো, আর অচেনা মেয়েকে পাবনা তাহলে তার সঙ্গে ছিঁচকেমি কর!
    একবার আমি আমার এক বান্ধবীর সঙ্গে বিকেলে ঘুরতে বেরিয়েছি। চুল ভিজে ছিল বলে আমার কোমর পর্যন্ত লম্বা চুল খুলেই বেরিয়েছি। হঠাত্ আমার মনে হল চুলের মধ্যে কিছু একটা পড়ল।বান্ধবীকে বললাম দেখত চুলে কি পড়ল। ও কিছুই দেখতে পেল না।কিন্তু আমরা দুজনেই দেখলাম হাত দুয়েক পেছনে একটি ছেলে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে সাইকেলের চেন ঠিক করছে। আমরা আবার হাঁটতে শুরু করলাম। ছেলেটিও সাইকেলে চেপে আমদের পেছন পেছন টুকটুক করে চালাতে লাগল। আবার আমার চুলে কিছু পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বান্ধবীকে বললাম এবার দেখ চুলে কি পড়ল! এবার বান্ধবীও দেখেছে। এবং যা বলল তাতে আমরা দুজনেই অবাক। পেছনের সাইকেলের ছেলেটি পানমশলা চিবাচ্ছে আর তার থুতুগুলো আমার চুলে ফেলছে! আমরা দেখে ফেলেছি দেখেই সে চোঁ-চাঁ দৌড়।---- আজ এতদিন পরেও আমি বুঝতে পারিনি সেদিন ওই ছেলেটা কেন ওরকম করছিল! কি শান্তি পাচ্ছিল সে ওটা করে? এর কি কোন ব্যাখ্যা হয়? ছেলেটাকে যদি জিগ্গেস করি তাহলে সে নিজে বলতে পারবে কেন করছিল? ক্ষণিকের একটা লালসা, ক্ষণিকের একটা না পাওয়ার অতৃপ্তি! এরা কি সব মানসিক রোগী? নাহলে একজন ঘরোয়া ভদ্রলোক যে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করছে, কিন্তু বাইরে অপরের স্ত্রীর সঙ্গে ছিঁচকেমি করছে! তখন কি সে ভাবে যে তার স্ত্রীর সঙ্গেও অন্য কেউ এরকমই ছিঁচকেমি করতে পারে !! অতটা ভাবার ক্ষমতাই নেই ------তাই তো মানসিক রোগী! বা , ভাবার ইচ্ছেই নেই! আগে তো মজা লোটো! অথবা, এরা সব হিংস্র, অত্যাচারী। হিংস্র না হলে একটি মেয়ের নরম বক্ষ যখন সজোরে মুচড়ে দিয়ে যায় এবং মেয়েটি যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে তখন তারা আনন্দে হাসতে থাকে? মানুষকে শারীরিক কষ্ট দিয়ে তারা খুব আনন্দ পায়।

নিষ্কাশ--2
*********
    ---"ধর্ষণ", শব্দটা বড্ড নগ্ন। আমাদের সাধারণ বাঙ্গালী পরিবারের ছেলে-মেয়েরা এখনো বড়দের সামনে ঐ শব্দটা উচ্চারণ করতে সঙ্কোচ বোধ করে। বরং, "ইভটিজিং" শব্দটা বেশ পর্দাবৃত। সকলের সামনে সাবলীলভাবে উচ্চারণ করা যায়। কেন? বিদেশী শব্দ বলে? কিন্তু একটি নগ্ন সত্যকে কোট টাই পরিয়ে দিলে কি তার মর্মটা বদলে যায়? আচ্ছা ইভটিজিং ও ধর্ষণের মাঝখানের বেড়াটা কোথায়? মানে কতদূর পর্যন্ত ইভটিজিং হলে সেটা ধর্ষণে পরিণত হয়? যেসব পুরুষেরা মেয়েদের মুখের দিকে না তাকিয়ে বুকের দিকে তাকায় তারা তো প্রতিনিয়ত চোখ দিয়েই হাজার হাজার মেয়েকে ধর্ষণ করে দিচ্ছে! রাস্তায় হাঁটার সময় পাশ দিয়ে সাইকেল নিয়ে পেরিয়ে যাওয়া 50-55 বছরের লোকটা যখন ঈষৎ ওপরের দিকে উঠে যাওয়া ওড়নার নিচের দিকে তাকিয়ে "বাপরে কি সাইজ" বলে খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতে চলে যায় তখন কি সেই মেয়েটার নিজেকে ধর্ষিতা বলে মনে হয় না? মনে হয় না এক বাজার লোকের মাঝখানে সে নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে?
    আচ্ছা ঐ ছিঁচকে ধর্ষকদের জন্য কোন ধারা নেই? কোন সাজা? একজন ধর্ষকের মনের অবস্থা বোঝার জন্য চিকিৎসকেরা অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন, কোন পরিস্থিতিতে সে এই অপরাধ করল তা বোঝার চেষ্টা করেন। কিন্তু এই ছিঁচকে ধর্ষকদের মনের মধ্যে কি চলতে থাকে যখন তারা এই ছিঁচকেমি গুলো করে? এইটা কি কোন সাইকোলজিস্ট কখনো চিন্তা করেছে?
     পৃথিবীর সমস্ত পুরুষ প্রজাতিকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।------সাধারণ পুরুষ, ধর্ষক, ছিঁচকে ধর্ষক। কিন্তু মহিলাদের একটিই শ্রেণী----ধর্ষিতা! এই পৃথিবীর প্রতিটি মেয়ে ধর্ষিতা। কেউ ধর্ষকের কাছে, কেউ বা ছিঁচকে ধর্ষকের কাছে! তা সে কালো হোক, ফর্সা হোক, মোটা হোক, পাতলা হোক, সুশ্রী হোক, কুশ্রী হোক, নাবালিকা হোক, সাবালিকা হোক,বাচ্চা হোক বা বুড়ি হোক; এইসব ছিঁচকেদের হাত থেকে কারুর রেহাই নেই!
_________________________________
© মমতা সিনহা

Saturday, 11 February 2017

।। সাধ ও সাধ্য ।।

সাধ হলেও করবো প্রেম, সাধ্য আমার নাই
আমি যে এক হকার যুবা, ঘরে অসুস্থ ভাই ।

বাবার ছিল কারখানার কাজ, কবেই গেছে চলে,
মায়ের এখন বিষম জ্বালা, উনুন কীসে জ্বলে ।

 বাধ্য হয়ে ছাড়লাম কলেজ, ফার্স্ট ইয়ারেই শেষ,
রোমান্স টোমান্স ছেড়ে এখন ধর্মতলাই বেশ  ।

সারা দিনই বেচাকেনা, দুটো পয়সা তো দরকার,
ঠিক নটা তে বাড়িতে ঢুকি, তবে চলে এ সংসার ।

কলেজ কাটা মামনিরা তো সবই ধর্মতলায় আসে,
'সস্তায় একটু দাওনা ভাই' বলে খিলখিলিয়ে হাসে ।

আমার তো এখন পোয়াবারো, দুটো কাজ ই ভালো,
মামনিরা বেশ গল্প করে,প্রেম নাই বা হলো ।

ভাইটা আমার রোগে ভোগা, কিন্তু বুদ্ধি ভীষন তার,
রোগটা সেরে গেলে জানি হবেই  ইনঞ্জিনিয়ার ।

গরীব বাড়ির ছেলে রে ভাই, প্রেম ভাবাটাই পাপ,
ওসব নাহয় পরের জন্ম, ঘরে অসহায় মা বাপ ।

রোজ ডে, কি প্রোপোজ ডে,কোনো দরকার নাই,
আমি জানি, চারটে পেট, একটি মাথা গুঁজবার ঠাঁই  ।।।
______________________________________
© জয়দীপ বসু

।। ক্লান্ত আমি ।।



আমি বড়ো ক্লান্ত!
শোষিতের তাজা রক্ত দেখে,
বিকলাঙ্গতার নানা রূপ দর্শে;
শিশুর খুনে ওরা তৃপ্ত আধুনিক
ওরা পৃথিবীদ্রোহী সন্ত্রাসী
নষ্ট মানবতার রাজা, ধ্বংসের প্রতিচ্ছবি,
তাদের পুঞ্জীভূত পাপ জাতিপুঞ্জ
শিকলে বাধা শিক্ষিত শয়তান৷

আমি বড়ো শ্রান্ত!
নবযৌবনার প্রতি দিশি শুকুনের
নির্দয় আক্রমণের সাক্ষী হয়ে,
প্রতিবন্ধী সরকারের পোষ্যদের
নারীর প্রতি বিরত্ব অবলোকনে,
সকাল সন্ধ্যায়
ভাবি নির্বাক নীরবতায়৷

আমি বড়ো অবসাদ গ্রস্থ!
সামান্য পথ হাটতে আমি অবসন্ন;
ক্রমে সংকীর্ণ হয়ে আসা
পথের পথিক হয়ে৷
কন্টকিত পথ চলতে চলতে
রক্তে রঞ্জিত পদতল,
যাত্রা থামাতে চাই আমি
কারণ আমি বড়ো ক্লান্ত৷
_____________________
© এ এস এম আবদুল্লাহ

।। ১৪ই ফেব্রুয়ারি ।।



রবিবার দিন নীলু সক্কাল সক্কাল আমার বাড়ি এসে হাজির। এসে সোজা আমার মাকে   বলে ওকে যেতে হবে কাশিপুর এক বন্ধুর কাছ থেকে কিছু পড়ার নোট আনতে ।  তাই আমাকেও সঙ্গে যেতে হবে। নীলুর হাবভাব এমন যে আমার মাকে  বলা মানেই যেন আমি যেতে বাধ্য।   চেয়ে দেখি নীলু যাওয়ার জন্য কোনো সাজগোজ করে আসেনি।  অবশ্য কাছে পিঠে বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার জন্য কে বা আর বেশি সাজগোজ করে। তখন নীলু সামনের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।  তাই বেশ কদিন আমি ওর সঙ্গে দেখা করিনি।  অবশ্য সেটা ওকে বলেই আমি দেখা করা বন্ধ করেছিলাম।

নীলু অবশ্য বেশি সাজগোজ না করলেই ওকে বেশি স্মার্ট দেখায়।  আসলে নীলুর  সাজগোজ করার অভ্যাস নেই , সে একটু সাজগোজ করলে কেমন আড়ষ্ট হয়ে যায়। যাই হোক দেখি নীলুর ছিপছিপে শরীরে প্যান্ট আর কুর্তা পরাতে  বেশ ঝকঝকে লাগছিলো।  রবিবার কিছু করার নেই।  তাই আমিও রাজি হয়েগেলাম নীলুর সঙ্গে ওর বন্ধুর বাড়ি যেতে।

পাড়ার মোড়ে  এসেই নীলু বলে চলো রিক্সায় স্টেশন যাই।  কাশিপুর যেতে হলে আমার বাড়ি থেকে বাসে যাওয়াটাই সুবিধা। আমি বলি, ' তুই ট্রেনে করে কাশিপুর কি করে যাবি ?' নীলু বলে বসে , ' আমাকে কাশিপুর যেতে হবে এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। ' আমি বলি, 'এইযে তুই বললি , নোট আনতে যাচ্ছিস কাশিপুরে তোর বন্ধুর বাড়ি। ' নীলু বলে , ' তখন ছিল কাশিপুর যাওয়ার প্ল্যান।  এখন প্ল্যান পালটে ফেলেছি।  গত কয়েকদিন পড়ে পড়ে মাথা জ্যাম হয়ে গেছে।  তাই আজকে তোমার সঙ্গে স্বপ্নযাত্রা করতে  যাবো। '  আমি বলি , ' স্বপ্নযাত্রা  সে আবার কি জিনিস ?' নীলু বলে , ' স্বপ্ন কি বলে কয়ে দেখা যায়।  স্বপ্নের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। কাজেই অপেক্ষা করো , সবুরে মেওয়া ফলবে। '

শিয়ালদা স্টেশনে নেমে নীলুর ইচ্ছে হলো বাবুঘাটে গঙ্গার হওয়া খাবে।  তখন বাজে বেলা এগারোটা।  নেহাত ফেব্রুয়ারি মাস বলে গরম গায়ে লাগছেনা।  তাই দুজনে বাসে  করে হাজির হয়ে যাই বাবুঘাটে।  ওখানে বাস থেকে নেমেই এক ঝালমুড়িওয়ালা থেকে নীলু ঝালমুড়ি নিলো।  দুজনে  ঝালমুড়ি খেতে খেতে বাবু ঘাটের ভিতরে ঢুকি।  আমি নীলুকে বলি , 'তুই ঝালমুড়ি খেতে বাবুঘাটে এলি কেন ?' নীলু বলে আমার  স্বপ্ন তোমাকে বলি।  ভবিষ্যতে  একদিন আমরা প্যারিসে সেন নদীর পাড়ে বসে ফ্রেঞ্চ ওয়াইন  খাবো।  তখন সেন নদীর হওয়া কেমন লাগবে তা আমি গঙ্গার হওয়া দিয়ে তোমাকে ছুইঁয়ে রাখছি। ' বেশ বুঝলাম আজ নীলুকে স্বপ্নতে  পেয়েছে।  নীলু কোনোদিন তার স্বপ্নের কথা বলেনা।  কেবল মাঝে মাঝে বলে. ' আমি জানি আমাদের দুজনের  ভবিষ্যৎ পরিষ্কার সুন্দর।  তাই ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করিনা। '

সেই বাবুঘাটে বসে আছি।  ফুরফুরে হওয়া দিচ্ছে।  নীলু চুপ করে বসে সারা গায়ে যেন হওয়া মাখাচ্ছে।  দেখে মনে হলো ওই আলখেল্লাধারী বুঝি নীলুর জন্য লিখে রেখেছিলেন

" আজ    একেলা বসিয়া , আকাশে চাহিয়া ,
            কী সাধ যেতেছে , মন!
    বেলা চলে যায় — আছিস কোথায় ?
           কোন্‌ স্বপনেতে নিমগন ? "

বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর নীলু বলে চলো মিউজিয়াম যাই।  আমি বলি, ' হটাৎ তোর আবার ইতিহাসে যাওয়ার ইচ্ছে হলো কেন ?' নীলু কোনো উত্তর না দিয়ে গেয়ে উঠলো
"স্বপন যদি মধুর এমন,
হোক না মিছে কল্পনা
জাগিও না আমায়, জাগিও না।।"

মিউজিয়ামে টিকিট কেটে ঢুকেই ভিতরে যে টানা বারান্দা আছে , সেখানে পাতা এক বেঞ্চিতে বসে পড়লো।  মাথার উপর ওই অতটা উঁচু সিলিং থেকে যে ফ্যানটা চলছে তার থেকে ঘটর ঘটার শব্দে বেশ হওয়া পাচ্ছি।  ঘড়িতে দেখি প্রায় একটা বাজে।  আমি বলি, ' চল মিউজিয়াম দেখবি যদি , তাড়াতাড়ি দেখে বাইরে কোথাও কিছু খেয়ে নেবো। ' নীলু দেখি কেমন এক ঘোরের  মধ্যে বলছে , ' একদিন লন্ডনে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ইজিপ্সিয়ান আর্ট গ্যালারি দেখবো , প্যারিসে লুভরেতে মোনা  লিসাকে দেখতে যাবো।  তখন কি তুমি কেবল খিদে পেয়েছে বলে আমায় তাড়া  দেবে। '  আমি বলি সে যখন আমরা ভবিষ্যতে যাবো তখন ভাববো , এখন শরীরটাকে কষ্ট দিয়ে কি লাভ ?'  নীলু দেখি আমাকে যেন আস্বস্ত করার জন্য বলে , ' সব হবে , সব হবে।  সাধে কি আর পূর্ণেন্দু পত্রী লিখেছেন

"অপেক্ষমান বুকের ভিতর কাঁসরঘন্টা শাখেঁর উলু
একশ বনের বাতাস এসে একটা গাছে হুলুস্থুলু
আজ বুঝি তার ইচ্ছে আছে
ডাকবে আলিঙ্গনের কাছে
দীঘির পাড়ে হারিয়ে যেতে সাঁতার জলের মত্ত নাচে।"

কলকাতা মিউজিয়াম পুরো দেখতে অনেকটা সময় লাগে।  দুজনে ঘুরে ঘুরে দেখছি , নীলু দেখে আর আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলে চলে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে কি কি ও দেখতে চায় , লুভরেতে কোন কোন শিল্পীর আর্ট ওয়ার্ক দেখার প্ল্যান ভবিষ্যতে।   মিউজিয়াম দেখে বেরিয়ে , শেক্সপিয়ার সরণির মুখে , একটা সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে বসে  দুজনে মশলা দোসা আর কফি খেলাম।  ঘড়িতে দেখি পাঁচটা বাজে।  নীলুর সঙ্গে দিনটা কোথা  দিয়ে পার হয়ে গেলো টের পেলামনা।  আমি বলি , ' তোর যদি স্বপ্নযাত্রা শেষ হয়ে থাকে , চল এবার বাড়ি ফিরে যাই। ' নীলু বলে, ' ধুর এখনো পর্যন্ত সুইজারল্যান্ড ঘোরা  বাকি আছে ।  চলো ভিক্টরিয়াতে  যাই। ' আমি বলি , ' এখন পাঁচটা বাজে।  ভিতরে ঢোকা বন্ধ হয়ে গেছে। ' নীলু উত্তর দেয় , ' ঢুকতে না হয় দেবেনা , কিন্তু ভিক্টরিয়া  মেমোরিয়ালতো আর চাদরে ঢেকে দেয়নি। '

ভিক্টরিয়াতে এসে পৌঁছতেই , নীলু লেগে গেলো ঘোড়ার গাড়ি দেখতে।  বেছে বেছে একটা সাদা ঘোড়ার গাড়ি পছন্দ করলো।  দুজনে ঘোড়ার গাড়িতে বসতেই নীলু গাড়োয়ানকে বলে , ' যতদূর যাওয়া  যায় , আমাদের ঘুরিয়ে নিয়ে এসো। ' তারপর আমাকে বলে , ' একদিন এমনি এক সাহেব গাড়োয়ানের ঘোড়ার গাড়ীতে বসে আমরা দুজনে , লেক জেনিভার ধারে ধারে ঘুরতে ঘুরতে সুইস চকোলেট খাবো।  ঘোড়ার গলার ঘন্টি যখন বাজতে থাকবে , তখন আমি তোমার মুখে শুনতে চাইবো  সুনীল গ্যানোপাধ্যায়ের কবিতা

"এই পৃথিবী বিদেশ তোমার
কতদিনের জন্য এলে?
বেড়াতে আসা, তাই তো মুখ অমন সুখ-ছোয়া!
যতি তোমায় বন্দী করি, মুঠোর মধ্যে ভ্রমর ধরি
দেবতা-রোষে হবো ভস্ম ধোঁয়া?"

আমি নিজের ঘড়িতে দেখি সেকেন্ডের কাঁটা টিক টিক করে এগিয়ে চলেছে, আর ঘড়ির  তারিখ আর মাস দেখাচ্ছে  ১৪ই ফেব্রুয়ারি।
_____________________________________
© সনৎ মিশ্র

।। অতন্দ্র প্রহরী ।।


   রে রে করে লাঠি নিয়ে
দৌড়ে আসা জনতা ------
পিটিয়ে ছিঁড়ল উর্দি
ঢিল মেরে ফাটালো মাথা!
জীবনভরের উগড়ানো রাগ-----
মনুষ্যতের নগ্ন নিদর্শন!
ছাপোষা মধ্যবিত্তের উগ্র
আস্ফালন আর বাহু প্রদর্শন!-----
" মার শালাকে! শালা ঘুষখোর!
হারামজাদারা চোরের থেকেও বড় চোর!"
আর মিডিয়াতে দেখানো
পুলিশের সেই ভুড়ি
তার সঙ্গে উপরি পাওনা---
বিদ্বজ্জনেদের খেউড় ঝুড়ি ঝুড়ি!
ঠান্ডা ঘরে চর্চায় মুখর,
চায়েতে কফিতে সুরুৎ সুরুৎ টান!
বিয়াল্লিশ ডিগ্রিতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে
উর্দির ভেতর হৃদয়টা ছটফট, আনচান।
তবু হাসিমুখে স্যালুট
এসি গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা খাদি----
ওপরওলার রাঙ্গা চোখের শাসন-----
কর্তব্যে হেলা হয় যদি!

     -----পুলিশ!! এক ভিন্ন প্রজাতি----
মানুষ তো নয়!.....
শরীরে মনে কায়ে পরিশ্রমে
ওরা অমানবিক কিছুই হয়॥
আমার সন্তান যখন বাবার সাথে
ফুটবল খেলে,
কোন পুলিশের সন্তান কোথাও
চোখের জল ফেলে।---
সকলের বৌ যখন
দেওয়ালির আনন্দে মাতে
পুলিশের বৌ তখন ঠাকুরের কাছে
আঁচল পাতে!

      তোমার কাজেতে আমি খুশি নই ;
তোমার কাজের আমি ভক্ত
সাধারণ মানুষের মাপকাঠিতে
তোমাকে মাপা যে বড় শক্ত!!
দিন রাত অষ্টপ্রহর,
সর্বক্ষনের অতন্দ্র প্রহরী------
তুমি আছো বলেই তো
নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারি ॥॥
_______________________
 ©  মমতা

Friday, 10 February 2017

।। HAPPY TEDDY DAY ।।



"সোনা, এই টেডিটা কি সুন্দর দেখতে। তাই তো নিলাম।
"তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না। কত বার বললাম ঐ বড় টেডিটা নাও। কিন্তু সেই তুমি ঐ বাচ্চা টেডিটাই নিলে? তুমি খুব কিপটে"
"আচ্ছা সোনা পরের বার ঐটাই কিনবো। রাগ করে না লক্ষীটি"
"ছাড়ো, পরের বার তুমি কি দেবে আমি ভালোই বুঝতে পারছি। কেন যে তোমার মত কিপটের প্রেমে পড়লাম"
" I am sorry জানু। Next বার sure"

হরেন একমনে রিক্সা চালাচ্ছে। কিন্তু না চাইতেও কপোত কপোতী প্যাসেঞ্জারের কথা কানে গেল। আজ নাকি টেডি না ফেডি কি একটা ডে । জীবনে প্রথম জানলো হরেন। এই সপ্তাহের সব বিভিন্ন দিনের নাম আস্তে আস্তে জানছে হরেন। জানার কথাও নয় তার। বাংলাদেশ বর্ডারের কাছে অজ পাড়াগাঁয়ে তার বাড়ি। নেহাত চাষের জমিটা মহাজন বেহাত করে নিল, তাই বউ নিয়ে শহরে এসেছে একমাস হল। তার ন্যাংটো বেলার বন্ধু পাঁচু অনেকদিন আগেই শহরে এসে রিক্সা চালায়। ওর দৌলতেই ভাড়ার রিক্সা চালাতে পারছে। খাল পাড়ে বস্তির ঘরটাও ওরই দয়া।

হঠাৎ করে সব চুপ। কপোত কপোতীর ঝগড়া আর কানে আসছে না। ওদের গন্তব্য রেলস্টেশন এসে গেছে। ভাড়া চুকিয়ে নেমে পড়ে তারা।

মেয়েটি হঠাৎ বলে ওঠে-
"শোনো একটা কথা বলি, পকেটের জোর না থাকলে প্রেম কোরো না। ঐসব middle class mentality আমার অসহ্য। আর এই টেডিটা তোমার মত মধ্যবিত্ত কাউকে জুটিয়ে তাকে দিও। আমার একটা prestige আছে। আমার friendদের এইটা দেখালে পুরো down হয়ে যাব।"

মেয়েটি টেডিটা রিক্সা তে রেখেই হনহনিয়ে প্ল্যাটফর্মের দিকে চলে যায়। ছেলেটিও বোঝানোর জন্য সেদিকে যায়। কিন্তু টেডি রয়ে যায় রিক্সাতেই। হরেন অনেক বার তাদের পেছু ডাকে , কিন্তু কেউ শোনে না। রাত্রি হয়ে গেছে, তাও হরেন দাঁড়িয়ে থাকে আধঘন্টা । দুটো প্যাসেঞ্জার ও ছেড়ে দেয়।

কিন্তু না কেউ ফিরে আসে না। হরেন এবার বাড়ীর পথ ধরে। বাড়ি ফিরে দরজায় আওয়াজ দেয় সে, পুতুলটাকে পেছনে লুকিয়ে। কিন্তু দরজা খুলতেই মালতির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আবিষ্কার করে যে হরেনের  হাতে একটা পুতুল। সে বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে-
" ওমা! পুতুল কিনেছো কেন? ভীমরতি হল নাকি? বাড়িতে কে আছে যে পুতুল খেলবে? কিন্তু বড় সুন্দর দেখতে তো। আর কি নরম। বল না শুধু শুধু পয়সা নষ্ট করলে কেন?"
" জানিস মালতী আজ না কি একটা দিন রে। নাম ভুলে গেলাম। আজ মনের মানুষ কে এই পুতুল দিতে হয়। তাই তোর জন্য এনেছি রে।"

মালতী হরেনের বুকের মধ্যে এসে মুখ লুকায়। এক আঙ্গুলে বরের ঘামে ভেজা গেঞ্জিটা জড়াতে থাকে। বলে ওঠে-
"মরণ! সোহাগ উথলে পড়ছে। ঐ টাকাটা হাতে থাকলে কত কাজ হত।"
কিন্তু মালতীর চোখে উপচে পড়া খুশী হরেনের চোখ এড়ায় না। মালতীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সে।

রাতে একপেট পান্তা খেয়ে বিড়ি ধরায় হরেন। পুতুল টাকে একটা চুমু খায় সে। আর ভাবে একটা ভাল্লুকের মত দেখতে পুতুল কত কি না করতে পারে।

#happy_teddy_day
_______________________________

©সুব্রত