মাননীয় বিচারপতি মেসোমশায় এবং এই কোর্টঘরে গত ক
দিন ধরে তামাশা দেখতে আসা আমার গুরুজনেরা।
আমি মন্টু সাউ পিতা সন্টু সাউ আদি নিবাস বিহারের
ছাপড়া বর্তমানে কলকাতার ক্যাওড়াতলা শ্মশানের পাশের ফুটপাথ। আমি রেপ কেসে অভিযুক্ত
হয়েছি। ক দিন বহুৎ মামলা চলার পর আমার চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে। মাত্র চার
বছর। কারণ প্রমাণ হয়েছে আমার বয়স চোদ্দ। অর্থাৎ আমি নাবালক।
যদিও আমার গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। যদিও ফুটপাথে আমার
জন্ম বলে কোনও বার্থ সার্টিফিকেট নেই। কিন্তু আমি যে নাবালক তা আইনের চোখে
প্রমাণিত। হদ্দ বোকা তো নই, পুলিশের হাতে ধরা পড়ে বুদ্ধি করে ইস্কুলের নাম বলেছিলাম। এক বছর আগে যে
স্কুল থেকে আমি ' উচ্চ প্রাথমিকের শিক্ষা সম্পন্ন
করিয়াছিলাম।' মানে কেলাশ এইট ড্রপ আউট হয়েছিলাম। ওই
ইস্কুলের মাস্টার মিড ডে মিলের লোভ দেখিয়ে আমাকে ইস্কুলে ঢুকিয়েছিল। কেলাস ওয়ানে।
বাচ্চা ধরে এনে ইস্কুল না ভরলে বাচ্চার অভাবে ইস্কুল উঠে গিয়ে মাস্টারের আরামের
চাকরি হারাম হয়ে যেত। তো, যাতে অনেক বছর ইস্কুলে থাকি,
আমাকে ওয়ানে বসিয়েছিল। ওপরআলা জানে আমার বয়স কত। কিন্তু,'
শিশুদের বয়স অনুযায়ী ক্লাসে ভর্তি নিতে হবে' - সরকারি নিয়মের গেরোয় আমার বয়স লিখেছিল ছয়। পুলিশ সে স্কুলের খাতা দেখে
এসেছে।
ইস্কুলে যেতাম মশাই পেটের দায়ে। পষ্ট বলছি। এক বেলা
পেট ভরে খেতাম, আরেক
বেলারটা চিল্লেমিল্লে বেঁধে নিয়ে আসতাম। পড়া? কে করে
মশায়! সিকখা সিসুর অধিকার। সিসুকে সারিরিক মানসিক কোনওরকম সাসতি দিলে সা--লা
মাস্টারের সাসতি হবে।
আট বছর ইস্কুলে পড়েছি। রোদ নেই, জল নেই রোজ গেছি। আর প্রার্থনার সময়
ঠাকুরকে ডেকে বলেছি যেন এক ক্লাসে বছর বছর ফেল করায়। ইস্কুলের ভাত ঝোল ডিম কিছু
বেশিদিন পাই।
ন্যায্য কথা ঠাকুরের কানে কখনো ঢুকেছে? সাত তাড়াতাড়ি কেলাস এইট খতম হল।
ইস্কুলের ভাত বন্ধ হল।
মাইরি বলছি, কতগুলো ফালতু য়্যাক্টিভিটি আর প্রজেক্ট মারাতে ইস্কুলে যেতাম না। বছর
বছর সিলেবাস নিয়ে যে মহাপুরুষগুলো ছেলেখেলা করে,তাদের
গায়ে আমার বিছুটি ঘষে দিতে ইচ্ছে করে। বড়লোকের ঘরের সুন্দর সুন্দর ছেলেমেয়েরা,
যারা সরকারী ইস্কুলে একটা চাকরী পাওয়ার জন্য, কম খাটনিতে মোটা মাইনে পাওয়ার জন্য বছরের পর বছর চাকরীর পরীক্ষায় ঘসটে
একবার বাজি মাত করতে পেরে ধরাকে সরা জ্ঞান করে, আমাদের মত
ছাত্তরদের তারা ঘেয়ো কুকুরের চেয়েও বেশি ঘেন্না করে। ওরা না কি আমাদের শিক্ষে
দেবে! ইস্কুলের সঙ্গে আমার পেট ভাতের সম্পর্ক ছিল, নাইনে
উঠে শেষ হয়ে গেল।
শুরু করলাম পেটের দায়ে ছিঁচকে চুরি। ভীড় বাসে
ছুটকোছাটকা কেপমারি দিয়ে শুরু করেছিলাম। তারপর জড়িয়ে গেলাম ওদের নেটওয়ার্কে।
গৃহস্থের বাড়ি থেকে দামী গ্যাজেটস, ড্রেস, জুতো, গয়না যা
পেতাম ঝেড়ে এনে বেচে দিতাম।সেই চোরবাজারে জিরে থেকে হীরে সবই চোরাই পাওয়া যায়।
যদিও এ কাজে বাচ্চা কোলে মেয়েছেলের রেট বেশি।
আমার নামে রেপ কেস করা সুনন্দিতা দেবীর বাড়ি আমার
ডেরা থেকে কাছেই। ফেমাস সিঙ্গার। সেলিব্রিটি। বছর তিরিশের বিধবা। বিশাল পুরনো
দিনের শ্বশুর বাড়িতে একগাদা কাজের লোক, গ্যারেজে গাড়ি, বাগানে মালি আর মেন গেটে
সিকিউরিটি নিয়ে একা থাকে।
এক রাতে সাকরেদদের নিয়ে বাগানে সুপুরি চুরি করতে
গিয়েছিলাম। দেখলাম ছাদের দরজা খোলাই থাকে। ওখান দিয়ে ম্যাডামের বেডরুমে খুব সহজে
চলে যাওয়া যায়।
সেখানেই এসেছিলাম সে দিন। মানে, বেডরুমের লাগোয়া ঠাকুরঘরে
কৃষ্ণবিগ্রহের সোনার মুকুট, সোনার বাঁশি আর আর বাইরের
ঘরের শো কেসের মেডেলগুলো আমার টার্গেট ছিল।
শেষরক্ষা হল না। ম্যাডাম বেডরুমের দরজা ভেজিয়ে জাগাই
ছিলেন। বেরিয়ে এসে হাতেনাতে ধরে ফেললেন আমায়। কিন্তু,
" যা বলছি, তাই করো। কেউ কিচ্ছু জানতে পারবে না। " আমার গেঞ্জি খামচে ধরে
কেমন হিসহিসে গলায় বলেছিলেন ম্যাডাম। সেই প্রথম তাঁর দামী খাটে শুয়ে উল্টোদিকের
বিরাট আয়নায় নিজেকে দেখে বুঝতে পেরেছিলাম আমি ওই ঠাকুরঘরের কেষ্টমূর্তির মতই
সুন্দর।
পেটের খিদের মতই শরীরের খিদে। যখন তখন চাগাড় দেয়।
ইস্কুলে মিড ডে মিল খেতে যেতাম। প্রতি রাতে সুনন্দিতার বাড়ি আসতাম মিডনাইট মিল
খেতে। মেন গেটে সিকিউরিটি সেলাম করে দরজা খুলে দিত।
ভালোই চলছিল।গোলমাল হল নতুন ল্যাপটপটা পেয়ে।
চোরবাজারে বিক্রি করে ভালোই লগগা হল। ওখানেই প্রায় সাদা জলের দরে আধ বোতল রঙীন জল
পেয়ে গেলাম। খুব উমদা চিজ। ফরাসি দেশের।
ও সব পেটে পড়লে নিজেকে রাজা বলে মনে হয়। টাস্কি খেয়ে
সুনন্দিতার ওপর চড়াও হলাম। ভর সন্ধেবেলা। ওর পুজোর সময়। সে তখন পাথরের কেষ্টর
রাধাগিরি করছে। রোজ রাতে যে শরীর খুব ভাল্লাগে, এখন নিজের অনিচ্ছার কারণে সেই শরীরের স্পর্শ পেয়ে এমন
করতে লাগল যেন একটা ক্ষুধার্ত বাঘ ওকে ছিঁড়ে খাচ্ছে। লোকজন জড়ো হয়ে গেল। সবার
চোখের সামনে আমি হয়ে গেলাম রেপিস্ট। আইন তো মেয়েদের ইচ্ছে অনিচ্ছের ই দাম দেয়।
আমার ইচ্ছে অনিচ্ছে দিয়ে কি এসে যায়?
অথচ যদি উল্টোটা হত, আমি মেয়ে আর ও পুরুষ? প্রথমবার
ও আমাকে ছুঁতে পর্যন্ত দু বার ভাবত। বোধহয় চুরির জন্য পুলিশে ডায়েরি ও করাতো না।
যদি আমি পালটা বলি আমাকে ফুটপাথ থেকে তুলে এনে অসম্মান করেছে।
আমার শরীরটা ও তো শরীর। প্রথমবার আমার শরীরে, মনে কি হয়েছিল, খোঁজ রাখার দায় কারো নেই। আমি যে পুরুষ।
যাই হোক, আমার সাকরেদরা আমার হয়ে অনেক ফাইট দিয়েছে। আমার জেল আটকাতে পারে নি,
অন্য কথা। আমি কিন্তু রেপ কেসের ক্রিমিনাল হয়ে জেলেই যেতে চাই।
চার চারটে বছর দু বেলা বাঁধা ভাত। আর কি চাই!
আমি না চাইলেও এ দেশের আজব আইন আমাকে অনেক কিছু দেবে।
অনেক বছর আগের একটা বীভৎস গ্যাং রেপের একজন আসামি শুধু নাবালক বলে অল্প ক দিন জেল
খেটে বেরনোর সময় মোটা আর্থিক ক্ষতিপুরণ, সেলাই মেশিন, কত কী পেয়েছিল।
যদি না ও পাই। জেল না কি এখন সংশোধনাগার। সেখানে
সাজাপ্রাপ্তদের পুনর্বাসনের জন্য কত কি শেখানো হয়। ওখানে অভিনয় শিখে একজন সিরিয়াল
কিলার তো টিভি সিরিয়ালের নায়কই হয়ে গেল।
মেসোমশায়, আমিও পারি। এতগুলো দিন কেষ্টগিরি শুধু শরীর নিংড়ে করি নি। একবার একটা
প্যাকেটে তিনটে ব্র্যান্ডেড জিন্সের সংগে একটা বাঁশের বাঁশি পেয়েছিলাম। ওটা নিজের
কাছেই রেখেছিলাম।রোজ নিয়ম করে ওতে ফুঁ দিতাম। রীতিমত সুর তুলতে পারি,
' আমি হাসি হাসি পড়ব ফাঁসি,
দেখবে ভারতবাসী '
না, আমি খুদিরামের মত নাবালক হলেও ওর মত বোকা নই। আমি শহীদ হতে চাই না।
মেসোমশায়, আমি বাঁচতে চাই। মেসোমশায়, আমাদের এই বিচিত্র দেশ, সোজাপথে মানুষকে মাথা
সোজা রেখে সহজে বেশি দূর চলতে দেয় না। তাই ভালোভাবে বাঁচার জন্য আমি চোর মন্টু
জীবনের চোরাপথের শর্টকাট বেছে নিলাম। হ্যাঁ, আমি ধর্ষক।
আমি অন্যায়ের জন্য জেল খাটতে চাই। জানি সেই
কারাবাসেই মিলবে শিক্ষা, তৈরি হবে সৎপথে কাজ করে সম্মান নিয়ে বাঁচার
সম্ভাবনা।
_______________
@ শর্মিষ্ঠা নাহা
No comments:
Post a Comment