Monday, 14 November 2016

।। বন্ধন ।।



                   (১)
   

       মানুষ বড় কাঁদছে। আধুনিক মানুষ উন্নত প্রযুক্তির সুখ অবশ্যই ভোগ করছে। পাশাপাশি বাই প্রোডাক্ট হিসেবে পেয়েছে সম্পর্কের রিক্ততা। একাকীত্বের যন্ত্রণা।
        আমি নন্দিনী কুণ্ডু। খুব ছোটবেলায় বাবা মায়ের গ্রামের বাড়ির টানাটানির সংসার ছেড়ে এসে কলকাতায় মামার বাড়িতে বড় হয়েছি। গ্র্যাজুয়েশনের পর চাকরির অপেক্ষা না করে শুরু করেছি নতুন ধরণের ব্যবসা। এই সম্পর্কের বন্ধনকে মূলধন করে।

          আমার  কাজটা সার্ভিস সেক্টরে খুব ইনোভেটিভ টাইপের। মূলতঃ মানুষের পাশে মরমী মন নিয়ে দাঁড়ানো। যে মানুষের অনেক আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য থাকা সত্ত্বেও প্রিয়জনের সান্নিধ্যের অভাব আছে, মোটা অর্থের বিনিময়ে তাঁদের জীবনের স্মরণীয় মুহূর্তগুলিতে তাঁর অনুপস্থিত প্রিয়জনের শূন্যস্থান পূর্ণ করার চেষ্টা করাই আমার মূল কাজ। ঠিক বোঝাতে পারলাম কি না জানি না।

        আমেরিকা প্রবাসিনী মিস রোমা পরাশরের কলকাতানিবাসী  বাবা মায়ের চল্লিশতম বিবাহবার্ষিকী পালন ছিল আমার কেরিয়ারের প্রথম ইভেন্ট। জমকালো সেলিব্রেশনে আমি সফলভাবে ওঁদের মেয়ের প্রক্সি দিয়েছিলাম।
        মিঃ দিলীপ বরজাতিয়ার ছোট্ট মেয়ের জন্মদিনে তার ডিভোর্সের জন্য অপেক্ষা করা মায়ের প্রক্সি মোটামুটি উতরে দিয়েছিলাম। সাম্মানিকের সঙ্গে ফিরে আসার সময় ছোট্ট মেয়েটার আদর আমার খুব বড় পাওনা হয়েছিল।
      এই করে করে আমার বেশ পসার বেড়েছে। বাবা মাকে ভালো টাকা পাঠাতে শুরু করেছি। মামাবাড়ির একতলার বাইরের ঘরে অফিস সাজিয়ে বসেছি। বাইরে সাইনবোর্ড ' বন্ধন অল লাইন সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড।  প্রোপাইটার : নন্দিনী কুন্ডু # # পাশে আছি সারাক্ষণ '

                   (২)
- নন্দিনী?
- ইয়া
- মাইসেলফ নিখিল
       বছর চল্লিশের জিনস - ফরমাল শার্ট পরা মানুষটা একটা কার্ড এগিয়ে দিলেন।
        নিখিলরঞ্জন ভট্টাচারজি......ফিজিওথেরাপিস্ট.....
- নিখিলরঞ্জন ভট্টাচার্য
- ও কে মিঃ ভট্টাচার্য,  বলুন আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?
- এই ফটোটা দেখুন
      এ তো ব্রাইডাল মেক আপে অবিকল আমি।
- আমার স্ত্রী মধুজা।
- হুঁ। তাঁর জন্য কি কিছু করতে হবে?
- বারো বছর আগে হনিমুন থেকে ফেরার সময় ট্রেনের কামরার বিধ্বংসী অগ্নিকান্ডে নিখোঁজ। দেহ শনাক্ত করা যায় নি।
- সো স্যাড
- বারো বছর অপেক্ষার পর কোনও নিখোঁজ মানুষ ফিরে না এলে তাঁকে মৃত বলে ধরে নিতে হয়। আমি আর আমার বাবা গঙ্গার ঘাটে মধুজার শ্রাদ্ধশান্তি করব ঠিক করেছি।
- ঠিকই ভেবেছেন
- কিন্তু আমার মা মধুজার মৃত্যু মেনে নিতে পারেন নি কখনো। হনিমুন থেকে আমাকে একা ফিরতে দেখে ইস্তক তিনি কেমন যেন ডিসব্যালান্সড হয়ে গেছেন। ওঁর মনে বদ্ধমূল হয়ে গেছে, আমি মধুজাকে বেঁধে রাখতে পারি নি বলে সে অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে চলে গেছে।
- আমাকে কি করতে হবে বলুন।
- সাইকিয়াট্রিস্ট বলছেন, মধুজার মত চেহারারএকজন মানুষ যদি মায়ের সামনে কোনওভাবে এসে দাঁড়ান, মায়ের মনে হয়ত একটা পজিটিভ এফেক্ট হবে। তিনি চিকিৎসায় দ্রুত সাড়া দেবেন।
- বুঝলাম।
- গোটা একটা দিনরাত আপনাকে আমার পরিবারের সঙ্গে মধুজার ভূমিকায় কাটাতে হবে।
- বেশ
- মা রেসপন্স করুন না করুন আপনাকে চব্বিশ ঘন্টার জন্য ফিফটি থাউজেন্ড দেবো। খুব কি কম হবে?
-না, ঠিক আছে।
- আর এই শাড়িটা নিন। মধুজাকে আমার মা দিয়েছিলেন। আমাদের বিয়ের রিসেপশনের। ওটা পরে এখনই চলুন। সবে তো সকাল সাড়ে দশটা। কপালে একটা লাল টিপ পরে আসবেন, প্লীজ।
       আমার সাজগোজ মুগ্ধ চোখে দেখে মাথায় কাপড়ের আঁচলটা তুলে দিলেন মিঃ ভট্টাচার্য।

                  (৩)

- ওগো শুনছো, একবার এসে দেখো কে এসেছে। রঞ্জুর সঙ্গে আমাদের সোনা মা ফিরে এসেছে।

        মিঃ ভট্টাচার্য আমাকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকতে চাইলে পথ আটকালেন ওঁর মা। হাতে সাজানো বরণডালা। ছেলের পাশে দাঁড়ানো আমাকে রীতিমত বরণ করে ঘরে তুললেন। আহা, দেবীপ্রতিমার মত রূপ ঘটনার অভিঘাতে কেমন আলুথালু হয়ে গেছে।
 - নে খোকা,ওর  সিঁথিতে একটুখানি ঘটের সিঁদুর ছুঁইয়ে দে। সধবার সিঁথি খালি থাকতে নেই।
- কি যা তা বলছ তুমি নতুন বৌ! ওঁর হাত থেকে আমাদের উদ্ধার করলেন মিঃ ভট্টাচার্যর বাবা।
- একটা মেয়ের সিঁথিতে সিঁদুর জীবনে একবার ই ওঠে। বিয়ের দিন।  সামাজিক আচার বিচার নিজের মত করে সাজাতে নেই। যাও, ঘরে গিয়ে তুমিই ওকে সাজিয়ে দাও।

         বুঝলাম, বিড়ম্বনার হাত থেকে আমাদের দু জনকে বাঁচিয়ে দিলেন এই লোকটা।
          সারাদিন একজন সব ফিরে পাওয়া মায়ের আদরে ডুবিয়ে রাখলেন ভদ্রমহিলা। ওঁর খুশি দেখে মাঝে মাঝে চোখে জল এসে যাচ্ছিল। শুধু একবার দু জনকে পাশাপাশি খাটে বসিয়ে আদরের ছলে দুজনের মাথা একসঙ্গে ঠেকিয়ে খুনসুটির ছলে যখন বলছিলেন, " দ্যাখ খোকা, তোর বৌ সেই টুকটুকেটাই আছে। তুই তো একদম বুড়ো হয়ে গেছিস",  ঘন হয়ে আসা অপরিচিত শরীরের গন্ধ নাকে যেতে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল।
         স্ত্রীর বায়নায় ফ্লোরিস্ট এনে ফুলশয্যা সাজিয়েছিলেন মিঃ ভট্টাচার্যর বাবা। কিন্তু আমার কাছে খুব কুন্ঠিতভাবে বারবার ক্ষমা চাইছিলেন। ওঁর ছেলে, মা ঘুমিয়ে পড়লে  যে বেরিয়ে গিয়ে গেস্টরুমে কাটাবেন, সে কথাও বারবার বললেন।

       মিঃ ভট্টাচার্যর বেডরুম খুব ছিমছাম সাজানো গোছানো হলেও ডবলবেড খাটটা ছাড়া বসার জন্য ওঁর পড়ার টেবিলের সামনে মাত্র দুটো রট আয়রনের চেয়ার। মায়ের আবদারে বাধ্য হয়ে ধুতি পাঞ্জাবী আর গলায় মালা পরা মানুষটা ওখানেই বসতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এই কনকনে শীতে ওভাবে কি কেউ পিঠ সোজা করে সারারাত বসে থাকতে পারে? ওঁকে বললাম খাটেই বসতে। "আপনি খুব ভালো" বলে খাটের ওপর পা ছড়িয়ে বসে সিগারেট ধরিয়ে তিনি একটু স্বস্তিবোধ করলেন।

        নতুন তাঁতের শাড়ি, শাঁখা পলার সঙ্গে মধুজা দেবীর একসেট গয়না, খোঁপায় রজনীগন্ধার মালা আর কপালে চন্দন পরে আমার বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। শীত ও করছিল খুব। বিছানায় রাখা বডি কমফর্টারটা চাদরের মত গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিলাম।
         দু জনে নিজেদের জীবনের কথা বলছিলাম একে অন্যকে। আমি বলছিলাম আমার বাবা মায়ের কথা, মামাবাড়িতে বড় হওয়া, অভিনব ব্যবসার প্ল্যান করে সেটা বাস্তবায়িত করার কথা। মিঃ ভট্টাচার্য বেশি করে বলছিলেন মায়ের অস্বাভাবিকতার কথা। তা থেকে তাঁকে মুক্তি দেওয়ার জন্য কতরকম কত চেষ্টা করেছেন - এই সব।

          কথায় কথায় কত সময় কেটেছিল কে জানে। একসময় আবিষ্কার করলাম, আমি মিঃ ভট্টাচার্যর বিছানায় আরামে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পাশে খানিক দূরত্বে তিনিও।
       আহা, কপালে চন্দনের ফোঁটা দেওয়া গলায় মালা পরা ঘুমন্ত মানুষটাকে কি স্বর্গীয়ই না দেখাচ্ছে।  ঠিক যেন রূপকথার রাজপুত্তুর। কিন্তু ঘুমের মধ্যে ধুতি উঠে গিয়ে দু পায়ের হাঁটু অবধি বেরিয়ে পড়েছে। এভাবে কতক্ষণ আছেন কে জানে। যাতে ঠান্ডা না লেগে যায়, বডি কমফর্টারটা গা থেকে খুলে ওটা দিয়েই ওঁকে ঢেকে দিলাম।

       কিন্তু তাতে নিজের যে খুব শীত করতে লাগল। ঘড়িতে দেখলাম ভোর পাঁচটা। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম।
- গুড মর্নিং,  সোনা মা।
- মর্নিং। আপনি কখন উঠলেন?
মিঃ ভট্টাচার্যর মা আমার কথার উত্তর না দিয়ে আমার হাত ধরে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেরই লজ্জা করতে লাগল। সিঁদুরের টিপটা কি বিশ্রিভাবে ধেবড়ে গেছে। ছিঃ, ভদ্রমহিলা না জানি কি ভাবলেন।
- উনি কোথায়?
পাশের খালি খাটটা দেখিয়ে বলি আমি।
      ওর মর্নিং ওয়াক ঠিক আছে, বুঝলে? পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও যেতে হবেই হবে। ফেরার পথে বাজার করে ফিরবে।  আজ কিন্তু তোমার পছন্দের সব রান্না করব, সোনা মা। সব খেতে হবে। একটাও না বলতে পারবে না।
- ইয়ে, মানে, আমি তো অতক্ষণ....

- একটা কথাও শুনতে চাই না তোমার। ওই তো কাজের মাসি এসে গেছে। ওকে বলি লুচি আলুর দম বানাতে। তুমি কত ভালোবাসো।  যাও, বাসি কাপড় কেচে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে নাও গে।

                    (৪)
         ব্রেকফাস্টের টেবিলে আমরা চারজন। আমার ঠিক সামনের চেয়ারে মিঃ ভট্টাচার্য।  ইচ্ছে না হলেও বারবার ওঁর দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। কেমন যেন লাগছে।
          ওঁর মা কিছুতেই আমাকে সার্ভ করতে দিলেন না। মাথার ঘোমটা নিয়েও খুব আপত্তি করলেন। খুব আদরের অতিথি যেন বা আমি, বৃদ্ধ দম্পতির হাবভাবে তেমনই মনে হতে লাগল। আমি যে ছানাপোড়া খেতে ভালোবাসি, ওই ভদ্রলোক কি করে জানলেন? এত কিছু ভালো জিনিস থাকতে ওটাই  আনলেন কেন?
- সোনা মা, তোমার জন্য খোকার বাবা আড় মাছ এনেছেন দুপুরে লাঞ্চ করে যেয়ো কিন্তু।
- আচ্ছা।

     বলেই খেয়াল হল আমার চলে যাওয়ার কথা ভদ্রমহিলা কেমন করে জানলেন?
- মা, মধু তো মাছ একেবারেই ভালোবাসে না। বাবাকে দিয়ে তুমি মাছ আনালে কেন?
- তোর বৌ কবে কোনকালে আমাকে ' আপনি' ডেকেছে রে খোকা? বিয়ের আগে এ বাড়িতে কতই তো এসেছে। বিয়ের পর যে ক দিন ছিল, এক মুহূর্তের জন্য এমন ঘোমটা মাথায় তুলে মুখ নিচু করে বসে থাকে নি।
        আমি টের পেয়ে গেছি খোকা, এ আমাদের মধু নয়। এ আমার একটা অন্য সোনা মা। কাল কথায় কথায় ওর ভালোলাগার কথা বলে ফেলেছে।  আজ চলে যাবে তাই ওর পছন্দের কিছু ওকে বানিয়ে দিচ্ছি।
- তুমি বুঝতে পেরেছ নতুন বৌ, ও মধুজা নয়?
- হ্যাঁ, ও তো নন্দিনী। খোকা আমার আড়ালে ওকে ওই নামেই ডাকছিল।মধুজা আর ফিরবে না।
        জানো, কাল রাত্তিরে আমি ওষুধ খাই নি। মেয়েটার মুখে আপনি শুনে ইস্তক বুঝে গিয়েছিলাম ও মধুজা নয়। কিন্তু ওর অভিনয় এত নিখুঁত ছিল যে মুখের ওপর সত্যিটা বলতেও পারছিলাম না।
        জানো, ওদের দু জনকে একসঙ্গে বেডরুমে যেতে বলেছিলাম ঠিকই, না বলে করতাম ই বা কি, কিন্তু বারবার মনে হচ্ছিল কেউ একজন বেরিয়ে আসবে। তাই সারারাত জেগে অপেক্ষা করেছি। সোনা মা, তুমি সেটাও ঠিক ম্যানেজ করে দিয়েছো। নিজের কাজে এত পার্ফেক্ট তুমি। তুমি খুব খুব ভালো।

- তা, এতই যখন ভালো তোমার সোনা মা, ওকে এ বাড়িতে রেখে দিলেই তো পারো, নতুন বৌ। বলো না ওকে।
        মিঃ ভট্টাচার্যর বাবা স্ত্রীকে কাতর অনুরোধ জানালেন।
- নন্দিনী, আমার সোনা মা, তুমি তো নিখিলের মুখে সব শুনেছ। আমাদের পুত্রবধূ মধুজা নিখোঁজ আজ বারো বছর হল। বেঁচে থাকার কোনও সম্ভাবনা নেই। শিগগিরি তাকে আমরা মৃত বলে ধরে নেবো। তারপর আমরা চাইব  আমাদের নিখিল যেন নতুন জীবন পায়। আমার ছেলেটা খুব খুব ভালো, সোনা মা। বলো, তুমি ওর নতুন জীবনে ওর সঙ্গিনী হয়ে থেকে যাবে? বলো না। সম্পর্কের নতুন বন্ধনে তোমরা ধরা পড়বে?
- আপনার ছেলের কি মত তা ও তো জানতে হবে।
- সামনেই তো রয়েছে। নিজেই জিগ্যেস করো না, বাপু।
- ইয়ে, মানে, মিঃ ভট্টাচার্য....
- নিখিল
- ইয়ে....মানে.... মা যা বলছেন....তাতে আপনি....তুমি.....রাজি আছো?
- ইয়ে..... মানে....মা যখন বলছেন......তখন তো......
__________
© শর্মিষ্ঠা নাহা

No comments:

Post a Comment