(১)
- এখন কি হবে বৌদিমণি? ক দিন পরেই যে মেয়ের বিয়ে। কি করে
কি হবে গো!
- জানি না বাপু। আমি তো আমার ডিউটি ঠিক ঠিক পালন করেছি।
বারো বচ্ছর আগে জোনাকিকে ছ বছরেরটি এই বাড়িতে কাজে লাগিয়েছিলে। এ বাড়িতেই এত বড়টি
হল। না হয় সরকারি ইস্কুলেই দিয়েছিলাম, মাধ্যমিকের
গন্ডি পার করিয়েছি। সংসারের সব কাজ, রান্নাবান্না,
মডার্ন গ্যাজেটস ব্যবহার করা সব হাতে ধরে শিখিয়েছি। এমন ম্যানার্স
শিখিয়েছি যে সবাই ভাবে আমারই মেয়ে।
তা, এত বছর আমার
বাড়ি কাজ করে যা রোজগার করেছে, সব তো আমার কাছে ব্যাঙ্কে জমা ছিল। খুব
কম না, চুরাশি হাজার। গতকালই ব্যাঙ্ক থেকে তুলে আনলাম। চুরাশিটা হাজারের
নোট। আর আজই কি না শুনছি টাকাগুলো অচল হয়ে গেছে! কি না কি ঘরে ঘরে জমিয়ে রাখা কালো
ধন পাকড়াও করতেই এই ব্যবস্থা! দু দিন ব্যাঙ্ক বন্ধ। তারপর লম্বা লাইনে
দাঁড়িয়ে টাকাগুলো আবার ব্যাংকে জমা দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু, আবার
লাইনে দাঁড়িয়ে একবারে দু হাজারের বেশি তুলতেও পারব না। কোথাকার কোন পাগলের পাল্লায়
পড়েছে দেশটা। কালো ধন টেনে বের করার চক্করে একটা মানুষের প্রয়োজনের সময় তার কষ্ট
করে রোজগার করা টাকা তার কাজে লাগছে না!
- কিন্তু জোনাকির বিয়ের কি হবে, বৌদিমণি? পাত্রপক্ষ
তো বসে থাকবে না। দিনক্ষণ সব স্থির। শুধু কেনাকাটা আর নেমন্তন্ন বাকি ছিল।
- কটা তো দিন, জোনাকির মা। একটা নতুন নিয়ম চালু হতে
যাচ্ছে, প্রথম প্রথম হয়ত একটু অসুবিধা হবে। পাত্রপক্ষকে বল না ক দিন অপেক্ষা
করতে।
- আমাদের ঘরের ব্যাপারসাপার তুমি কি বুঝবে বৌদিমণি। আঠারো পূর্ণ হল, এখন
স্বম্বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে না দিয়ে মেয়ে ঘরে রাখলে পাঁচজনে পাঁচ কথা বলবে। আর
পাত্রপক্ষই বা কেন ছেলে ফেলে রাখবে? এমনিতেই মেয়ে
কালো বলে একটু নিমরাজি মত আছে। নেহাৎ মাধ্যমিক পাস করা মেয়ে ওদের বাড়িতে আর একটাও
নেই, আর তুমি বলেছ বক্স খাট আর ওয়াল ইউনিট যৌতুক দেবে, তাই.....
- দেখো জোনাকির মা, যারা এই বিপদের কথা জেনেও দু দিন অপেক্ষা
করতে পারে না, সে বাড়িতে গিয়েও তোমার মেয়ে শান্তি পাবে না, শুনে
রাখো।
মেয়ে তো আমার কাছেই আছে, কিচ্ছু
জলে পড়ে নেই। ক দিন পর আবার এসো। দেখি কি করা যায়। শোনো, আমার
মেয়ে নেই তো কি হয়েছে, তোমার সমস্যা আমি ভালোই টের পাচ্ছি। কিছু
একটা সুব্যবস্থা আমি ঠিকই করব। আমার ওপর ভরসা রাখো।
(২)
- এসো জোনাকির মা। বসো।
এই যে
আমার ছেলে অভিষেক। অভিষেক রায়চৌধুরী।
- এ কি, এ কি। আমার পায়ে হাত দিচ্ছেন কেন
আপনি?
- আরে জোনাকির মা, তুমি পল্টুকে চিনতে পারছ না! তুমিই তো
কোলে পিঠে করে ওকে রাখতে। সেই নার্সারিতে বোর্ডিং স্কুলে চলে গেল, তখন কত
কেঁদেছিলে। কি আর করব বল। পল্টুর বাবা অকালে চলে গেলেন। একা হাতে ছেলে আর চাকরি কি
করে সামলাবো, তাই একমাত্র কোলের ছেলেকে বাধ্য হয়ে বোর্ডিং স্কুলে দিয়ে দিয়েছিলাম।
তো, পল্টু এ দেশে, বিদেশে
অনেক লেখাপড়া শিখেছে। বেশ ভালোই মানুষ হয়েছে। সরকারি দপ্তরের মস্ত বড়
অফিসার। এখন পুনায় পোস্টিং আছে। পঁচিশ বছর বয়স হল। এবার বিয়ে থা করে সংসারী হওয়ার
ইচ্ছে।
- মানে.... বৌদিমণি..... জোনাকির ব্যাপারটা....
- সেটাই তো বলছিলাম। সে দিন ভিডিও চ্যাটে জোনাকির সঙ্গে কথা বলিয়েছিলাম
পল্টুকে। দু জনের দু জনকে মোটামুটি পছন্দ বলেই মনে হল। তো ছেলে বাড়ি এসেছে। এখন
তোমার মত থাকলে শুভকাজটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে পারি।
ইয়ে, মানে, টাকার
সমস্যা তো খুব বড় সমস্যা। ভাবছি, আগামীকাল বিয়ের ডেট আছে। পাড়ার
কালিমন্দিরে বিয়ে দিয়ে ম্যারেজ রেজিসট্রারের অফিসে গিয়ে ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন
করিয়ে নেবো। তারপর জোনাকি আপাতত এখানেই থাক যেমন ছিল, আর
পল্টু ওর কাজের জায়গায় ফিরে যাক। নোটের সমস্যা মিটলে খুব বড় করে ম্যারেজ রিসেপশন
করব। আমার তো একটাই ছেলে। শখ- আহ্লাদ একটু আছে বৈ কি।
এর মধ্যে
জোনাকিকে বরং ইলেভেনে ভর্তি করে দিই। উচ্চ মাধ্যমিকটা পাস করুক। তারপরেও যদি পড়তে
চায়, খুব ভালো হয়।
মানে, বুঝলে
কি না, আমার একটাই দাবী আছে। আমার একমাত্র ছেলের বৌ, একটু
লেখাপড়া জানা হবে।
_________
© শর্মিষ্ঠা নাহা
No comments:
Post a Comment