কিন্তু
সাধারন মানুষ তো সাধারন মানুষই, তারা তো আর সেনা নয়, যে যুদ্ধকালীন সকল
পরিস্থিতিতে সকলেই মানিয়ে নেবে বা নিতে পারবে। ইমপ্লিমেন্ট পদ্ধতি নিয়ে সকলকেই চরম
সমস্যার স্মমুখীন করে দিয়েছে। ফেসবুক
টুইটারে যারা অন্ধভাবে মাতামাতি করছেন, বা কালাধনের উদ্ধারের আনন্দে দিশাহারা,
তাদের মধ্যে অধিকাংসেই দেখলাম চাকুরিজীবি বা এখনও পেশাপ্রবেশ ঘটেনি। সব বৈপ্লবিক
ভাষনে সমৃদ্ধ প্রবন্ধ।
কজন
ব্যাবসাদার এ বিষয়ে কোন পোষ্ট বা মন্তব্য করেছেন? অতি অতি নগন্য।
কিছুজনের ধারনা, ব্যাবসাদার মানেই বাটপার বা চোর সমতুল্য। অনেকেই আবার মনে করেন
ব্যাবসাদার? ওরা আবার কি বলবে? যেন এরা একটা সমাজ বহির্ভুত জীব।
আরে
বাবা আপনিও যে চাকুরিটা করেন সেটা কোন ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানেই। সেটা সরকারি হোক
বা বেসরকারি , বা লাভজনক বা সেবামূলক। তাই ব্যাবসাদারেরা বোকা এমন ধারনাটা বোধহয়
সবচেয়ে বড় বোকামো। যাদের
যাবতীয় হিসাব মাসিক ৩০-৫০ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ, তারা এই লক্ষ কোটিটাকার
কালাধনের উদ্ধারের স্বপ্নে বিভোর। কোটিতে কটা শুন্য শুধালেই অনেকের পেট ফাপে তারাও
এই আগুনে বুলিতে দুকাঠি এগিয়ে।
আমাদের পরিবারের খরচাও এমনটাই যতটা চাকুরীজিবী বন্ধুদের,
সেটা আমার স্টার জলসা প্রেমী 'মা' সামলান, তাই এই চাকুরীজিবী বা এখনও বেকার
বন্ধুদের মতই তিনিও খুব উত্তেজিত এবং আহ্লাদিত। ব্যান হয়েছে ৫০০-১০০০ টাকার নোট,
কিন্তু আকাল লেগেছে যেগুলো চালু আছে সেই খুচরো নোটে।
ঠিক
কোথা থেকে অতিরিক্ত রেভিনিউ আসবে, কতটা তার লক্ষ্যমাত্রা বা এসে কোথায় যাবে এ
বিষয়ে বেশি জানতে চাইলেই, মুখ আর অন্তর্বাসের মধ্যে প্রভেদ ঘুচছে। দেশের অর্থনীতিতে কালো টাকার পরিমান কতটা? জালটাকাই বা কত? নতুন নোট ছাপানো আর পুরাতন নোট নষ্ট করার খরচা কত? না প্রশ্ন তোলার উপায় নাই, তাহলেই আপনার দিকে দেশদ্রোহীর তকমা সেঁটে দেবে। সাথে অন্তহীন গালিগালাজ। চুম্বকে এটাই দেশজ পরিস্থিতি।
অনেকেই সন্ত্রাসবাদের প্রশ্ন তুলছেন , যে তারা খুব জব্দ হল। আরে বাবা তালীবান,
বোকোহারাম, বা চেচিনিও বা আধুনা সভ্যতার কলঙ্ক ISIS জঙ্গিগোষ্ঠীও তো বিশ্ব
অর্থনীতির লেনদেনের চালিকাশক্তি ডলারে পুষ্ট। সুতরাং এই বুদ্ধিতে তো ডলার নিষিদ্ধ
করতে হয়। নাকি ধরে নিতে হবে পশ্চিমি দাদাদের এখনও সেই বোধ আসেনি।
সঠিক কোনটা সেটা সময়ই বলবে। কতগুলো আমার বাস্তব সমস্যা বলি।
আমাদের
ব্যাবসায় ৭০% চাষীর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। তারা ধান বেচতে এসে নাজেহাল। নাগদ দেন
বাবু, একাউন্টে ঢোকালে বাইরের মুনিশ, গাড়িভাড়া মেটাবো কিকরে? সপ্তাহে তো কুড়ি
হাজার তাও দুটোদিন রোজ কামাই করে। ব্যাঙ্কেও টাকার যোগান নাই, চেয়েচিন্তে অনুনয় বিনয় করলে ৫০০০ টাকা মিলছে গ্রামাঞ্চলের প্রায় সব ব্যাঙ্কে। এখন ওদের কি করে বোঝায় নগদ আমরাই বা পাবো কোথায়! আমাদেরও তো কোটা সেই একই। আমাদের এই দৈনন্দিন বিপুল পেমেন্ট কিভাবে একশ পঞ্চাশ টাকায় করব! কাঁচা মালের
আমদানি প্রায় বন্ধ, সুতরাং প্রডাকসন থমকে, উৎপাদিত পন্য বিক্রি নেই, পেমেন্ট করব কিভাবে? বিক্রিও বন্ধ, খদ্দেরের কাছেও সবচেয়ে কম
১০ টন চাল কেনার জন্য কমপক্ষে দুলাখ টাকা নগদ ১০০ টাকার নোট নেই বা নতুন কারেন্সিও
নেই। ছোট ব্যাবসাদারেরাও তো নগদের মাল কেনেন। যারা বলবেন চেকে কেন লেনদেন করেননা, তাদের বলি , দাদা আপনি কোনোদিন চেকে চাল কিনেছেন? সুতরাং আপনি দোকান থেকে কেনেন নগদে, দোকানদার সেই নগদ দেয় হোলসেলারদের, আর হলসেলাররা ডিষ্ট্রিবিউটরদের মাধ্যমে রাইসমিলে চালান দেন। বৃত্ত সম্পূর্ণ। আলুর জন্যও তাই, বাকি অন্যান্য ব্যাবসার হালও সেম। বিষেষ করে প্রোডাকশন
ব্যাবসার ক্ষেত্রে।
এক
আধদিনের মধ্যে চাকা বন্ধ হবে কাচামালের অপ্রতুলতায়। ভিন রাজ্যের খদ্দেররা জাষ্ট
হাওয়া হয়ে গেছেন। দু এক সপ্তাহে নিশ্চই পরিস্থিতি শোধরাবে, কিন্তু কোম্পানিগুলো এই
বিপুল লোকসানে ভার বইবে কিভাবে? নুন্যতম ইলেকট্রিক বিল, পার্মানেন্ট লেবার খরচা,
মেসের খাই খরচা, রাহা খরচা, মেন্টেনেন্স... এগুলো কি থেমে থাকবে? ব্যাঙ্কের লোনের
টাকা তো বাচ্চা দেবে।
বাজারে
চাষীর উৎপাদিত পন্যের খদ্দের নাই বললেই চলে নগদ যোগানের অভাবে। এক কুইন্টাল ধানের
দাম প্রায় ১৫০০ টাকা, একজন ক্ষুদ্র চাষীর ২০ কুইন্টাল ধানের ৩০০০০ টাকা কিভাবে
মেটাবো? ব্যাঙ্কে আড়াইলাখের বেশি জমা করতে যাওয়ার থেকে হেঁটে কোলকাতা যাওয়া সহজ
মনে হচ্ছে। অথচ যাদের রোজ ১০০ টন প্রোডাকশন , তাদের দৈনিক ট্রানজাংসান ৪০ লাখ বা
তারও বেশি। কিন্তু কে ভেবেছে এদের কথা। ২০ হাজারে খাবে কি আর মাখবে কি?
কাল
হাইকোর্টে গেছিলাম। জাজদের ঢোকার গেটের বাঁহাতে একজন বয়স্ক ফুলগাছওয়ালা বিলাপ
করছিল, আমার সব গেল। সকলেই বর্তমান দূর্মুল্য ১০০ টাকা বা খুচরো বাঁচাচ্ছেন। তাই
কটাদিন ওই 'শখের' ফুলগাছ কিনে কেও 'ফালতু খরচা' করতে নারাজ। তাহলে ওই গাছওয়ালার
চলবে কি করে। সবে কোর্ট খুলেছে, সে একটু বেশি করেই ডালিয়া চন্দ্রমল্লিকা সহ
সিজিনাল ফুলের চারা তুলেছিল। এতো আর চাল ডাল নয়, যে ১০-২০ দিন সংরক্ষণ করা সম্ভব।
বিক্রিবাটা না হলে এগুলো শুকিয়ে মরে যাবে। সুতরাং পুঁজি ফাঁক। আবার কেরালা যেতে
হবে জোগাড়ে খাটতে। সে বুঝে পাচ্ছেনা ঠিক কাকে দোষ দেবে। এমন কত শত ব্যাবসাই আছে,
এই হঠাত করে জরুরী অবস্থা পুঁজি ফাঁক করে দিচ্ছে।
কে
রাখে সেই খবর!
সবাই
দুটো দিনের প্রতিক্ষায়, যখন সব আবার আগের মত হবে। কিন্তু ততদিনে অভাবি বিক্রি তো শুরু
হয়ে গেল। সুদি কারবারিদের গুদামে কাঁসা পিতলের হাঁড়িকুঁড়ি, রুপোর অলঙ্কার জমতে
শুরু করেছে সবে। সেই সকল কারবারীদের আটকাতে সরকার কোন ব্যাবস্থা নিয়েছে কি? এই সব
মিনি মাইক্রো রক্তচোষা বাদুরের সন্ধান আয়কর দপ্তরের সীমানার বাইরে। সব লেনদেনই তো
কাঁচাতে হয়। আর এদের সাথে স্থানীয় প্রশাসনের একটা অংশ বখরা খায়। এদের আচ্ছেদিন
সন্দেহ নাই। দাদনের ব্যাবসা নতুন উদ্যোমে পাড়াগায়ে গেঁড়ে বসছে। এগুলো মাটির সাথে
যোগাযোগশুন্য ফেসবুকের চাকুরীজীবি বন্ধুদের অজানা।
এবার
আমাদের কারখানার লেবার পেমেন্ট। গুটি কয়েকজন বাদ দিলে, প্রায় দু লক্ষ টাকা কমবেশি
সাপ্তাহিক পেমেন্ট করতে হয় তাদের। সবটাই নগদে। এ সপ্তাহে সব ধারে চলছে। সবাই তো
দিন আনে দিন খাই, সামনের সপ্তাহে কোত্থেকে টাকা মেটাবো? তারাই বা খাবে কি?
কাচামালের অভাবে ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকলে তো ডেলিলেবাররা কর্মহীন আপাতত।
চাকুরীজিবীদের
নাহয় ব্যাঙ্কে আছে, আজ না হয় কাল ব্যাঙ্ক থেকে চার হাজার বেরোবে। তাদিয়ে
কষ্টেসৃষ্টে চলে যাবে। এই লেবারগুলোর চলবে কিভাবে, চাষীগুলোর কি হবে? আমি বা
আমাদের মত ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ীরা কোত্থেকে মেটাবেন তাদের ন্যায্য মজুরী? আমি অনলাইন
ট্রান্সফার বুঝি, পেটিএম বুঝি, কিন্তু তারা কি পেটিএম জানে? তাছারা নতুন মাপের
500/2000 নোট বতর্মান. ATM carry করতে পারবে না। সুতরাং আগামী কিছুদিন সমস্যা
বারবে বই কমবেনা। ।
সবাই
নিজের আয়নাতে নিজেকে দেখে ফেসুবুক টুইটারে ভাষন দিচ্ছি। আমার চেনার দৌড়ে থাকা এই
লেবার বা চাষী যারা এই ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের দুনিয়াতে নেই, তারা কি মিথ্যা?
বিগত
তিন দিন থেকে একটা ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি আজও বানানে পারিনি। ক্লান্ত ব্যাঙ্ক
কর্মচারীগুলো কে দেখলেও মায়াই হচ্ছে, সককে ভাল রাখার দায় নিয়ে প্রায় নির্ঘুম কাজের
নির্ঘন্ট তাদের।
ছোট
ব্যাবসাদার, অসংগঠিত শ্রমিক, আর ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষক। এটাই তো আসল ভারতবর্ষ।
এরাই ক্রেতা এরাই উৎপাদক। আর এরাই অসহায়, ভারতবর্ষ অসহায়। সোফায় বসে, ক্যারাম
খেলার ফাঁকে আড্ডা মারতে মারতে একটা অম্লমধুর মন্তব্য বা প্রবন্ধ পড়তে ভাল, বাহবা
পেতে ভাল। বাস্তবটা লড়ায়ের জাইগা।
একজন
লোক কখন চুরি করে জানেন?
যখন সে লজ্জায় ডুবে থাকে। হজম হল না তো?
একজন মানুষ যখন অসহায় হয়ে যায়, প্রতিটা বার পিছিয়ে পরে অথচ হাত পাততে পারেনা, তখন
অগত্যা অন্ধকারে চুপিসারে চুরি করতে সাহষ পায়। এরপর লোভ আর ঘোমটা আঁটা সুশীল সমাজ
তাকে অপরাধের বৃহত্তর বিশ্বে প্রবেশ করায়।
কিছু
মানুষ আজ চরম অসহায়তার ঠিক কাঠগড়াতে দাঁড়িয়ে। তারা নিজেও জানেনা সামনের ভবিষ্যৎ টা
ঠিক কি।
সবে
কলির সন্ধ্যে। সমস্যার সমাধানে দ্রুত উচ্চস্তরীয় সিদ্ধান্ত না নিলে বহু কিছুই মুখ
থুবরে পড়বে তাতে সন্দেহ নাই। তাতে আমার এই বিপ্লবী বন্ধুদের ঘর সেই আঁচ থেকে যে
রক্ষা পাবেনা সেটা বলাই বাহুল্য।
_____________
© তন্ময় হক
No comments:
Post a Comment