Saturday, 25 March 2017

।। সাহারার মরুভূমি ।।

আমি একলা দাঁড়িয়ে বিরাট ভীষণ
সাহারার মরুভূমি---
বহুযুগ থেকে বালিয়াড়ি হয়ে...
দুর্গম সীমাহীন রহস্য নিয়ে ,

কোনো এক কালে সবুজ বনানী ছিলো ,
কতো নদী বয়ে গেছে বৃষ্টির কতো জল ,
কতো পাখি গেয়ে যেতো গান --
মানুষ কেটেছে সবুজের বন ,
প্রকৃতি পেতেছে বালির চাদর !
বড় অভিমানে চিরবসন্ত বিদায় দিয়েছি আমি..
কখনও উষ্ণ আবার শীতলও  ,
তবু ভালবাসা ভরা বৃষ্টির সুখ দেয়নি কোনো আকাশ ,
আজ ভীষণ শুকনো তৃষাতুর আমি বালি ।

হঠাত্ তুষার ঝড় আলজিরিয়ার বুকে ,
ভালবাসা যেনো তুষারবৃষ্টি হয়ে --
শুভ্র সাদায় আমাকে ঢেকেছে আজ ,
ভালবাসা আজ চুম্বন হলো ,
ভালবাসা আজ শরীরী মিলন ,
ভালবাসা আজ শুকনো মাটিতে এক বুক জমা জল ---
আজ তৃপ্ত সাহারা মরুভূমি এক -তৃপ্ত বালির প্রান্তর ॥
___________________________
© বৈশাখী চ্যাটার্জী

।। একটি কন্ডোমের আত্মকথন ।।

           আমি উন্নতমানের ল্যাটেক্স নির্মিত স্ট্রবেরি ফ্লেভারের একটি লাক্সারি কন্ডোম। জন্মনিরোধক লুব্রিকেটিং জেল মাখানো। কারখানার মেশিনে প্রোডাকশনের পর একটি আলাদা এয়ারটাইট প্যাকে ভরে আমারই মত প্যাকড আমার আরও দুই জাতভাইয়ের সঙ্গে আমাকে একটা ট্যাম্পারপ্রুফ প্যাকে ভরে সদ্য সিল করা হয়েছে। এরপর আমাকে এমন আরও অনেক প্যাকের সঙ্গে কোনও মেডিক্যাল স্টোরে পাঠানো হবে।
        স্টোরের তাকে আমার বাক্স রাখা থাকবে সব ওষুধের বাক্সের পাশে। লোকে সারা দিনরাত কত কত ওষুধ নির্দ্বিধায় কিনবে। কিন্তু আমার বাক্সটার দিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে  কোনওমতে দেখাবে। সে টানটান সদ্য যুবাই হোক অথবা টাকমাথা ভুঁড়িওয়ালা মধ্যবয়সী। সদ্যবিবাহিত বর ই হোক বা ডেটিংয়ের প্রেমিক। কিংবা বেশ্যালয়গামী বাবু। অথচ ওষুধের মত আমারও নাম আছে।
         আমাকে জন্মনিরোধক বলা হয়। ' নিরোধ ' ও বলে কোনও কোনও নির্বোধ। হ্যাঁ, বলতে বাধ্য হচ্ছি তারা নির্বোধ।  সঙ্গমকালে ল্যাটেক্স ফেটে গিয়ে অবাঞ্ছিত জন্মের ঘটনা প্রায়শই ঘটে। আর যারা আমাকে যৌনসংক্রামিত রোগের নিরোধক বলে ঢালাও প্রচার চালায়,  তারা নিজেরা নির্বোধ, না এই সব প্রচার চালিয়ে গণ ব্রেনওয়াশিংয়ের মাধ্যমে জনগণকে নির্বোধ বানাতে চায়, আমার জানা নেই।
       যৌনসংক্রামিত রোগ আমাদের ব্যবহারের মাধ্যমে কিছুটা হয়ত নিয়ন্ত্রিত হয়। সেটা খুব সামান্য। কোনও কোনও যৌনরোগ তো বীর্য এবং যোনিরস ছাড়াও যে কোনও দেহতরলের ( যেমন-লালা) মিশ্রণের মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে। দেশের নাগরিকদের মধ্যে উন্নত মূল্যবোধের প্রসার না করে শুধু আমাদের ব্যবহারের কথা ফলাও করে প্রচার করলে সেটা একেবারেই 'বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া' হয়ে দাঁড়াবে। ( অনেকটা বড় বড় গাছ কেটে অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণের পর ' আপনার ফ্ল্যাটের বারান্দায় একটি তুলসিগাছ হলেও লাগান। বৃক্ষরোপণ করুন। ' জাতীয় হাস্যকর প্রচার।)
        আর হচ্ছেও তাই। যাঁরা সত্যিকারের বহুগামী তাঁরা ' এ সব ব্যবহারে মস্তি আসে না' বলে আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়েই রাখেন। হাজারো ফ্লেভার দিয়েও, লক্ষ স্বল্পবসনা পর্নোস্টারকে মডেল করিয়েও আমাদের ব্যবহারের জন্য এঁদের উৎসাহিত করা যায় না। যৌনপল্লীতে বিনামূল্যে বস্তা বস্তা সরবরাহ করার পরও, সংশ্লিষ্ট যৌনকর্মী ক্লায়েন্টের হাতে তুলে দিলেও খুব কম ক্লায়েন্ট লক্ষ্মী ছেলের মত তা ব্যবহার করেন। যৌনরোগ আপন খেয়ালে ছড়িয়ে পড়ে।
          আমার নাম 'নিরোধ' হলেও আমার ক্ষমতা কেবলমাত্র  অবাঞ্ছিত জন্ম এবং কিছুটা যৌন সংক্রমিত অসুখ নিরুদ্ধ করাতেই সীমাবদ্ধ।  এবং হ্যাঁ। আমাদের স্থান নরনারীর সঙ্গমকালে কেবলমাত্র পুং যৌনাঙ্গ বেষ্টন করে। অন্য কোথাও ( যেমন- বন্দুকের নল)
লাগিয়ে দিলেই আমাদের ক্ষমতা নেই অন্য কিছু ( বুলেটের গতি)
রোধ করার। আবেগের বশে অনেকের মুখ এবং কলম/ কি বোর্ড দিয়ে অনেক কথা বেরোয়। বক্তা/ লেখক যত বড় সেলিব্রিটি ই হোন না কেন, যত গুরুতর পরিপ্রেক্ষিতেই বলে থাকুন না কেন ,  চোখ কান বুজে ইগনোর করুন। চেঁচিয়ে লোক জড়ো করবেন না। সোশাল মিডিয়ায় ঝড় তুলে নিজেদের মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না।
        আমাদের যথাযথ ব্যবহার করুন এবং আনন্দে থাকুন।

© শর্মিষ্ঠা নাহা

Saturday, 18 March 2017

।। দূরত্ব ।।


মৃত্তিকার ঘ্রাণ নিতে নিতে লুডমিলা বল্ল
মাটির গন্ধ এতো কাছে টানতে পারে অনিন্দ্য?
অথচ আকাশের দূরতম তারাটা কখনোই পাবেনা
এ প্রকৃতিজ সুঘ্রাণ!

আমি বল্লাম তবে কেন দূরে থাকা হে নক্ষত্র সুন্দর?
এসো অবনত প্রেম হই
ভালোবেসে মাটি হই- তুমি আমি দু'টি প্রাণ।
___________________________
© মোশ্ রাফি মুকুল

।। পরশ ।।

স্পর্শেও কতো আকুলতা থাকে জানো ?
ঝরা পলাশের নেশায় মাতাল মনে –
অকারণ সব ছেলেমানুষির ভাষা
বলে ফেলা যায় নীরবেই, অকারণে।

মেঘলা বিকেলে আলো ফুটে ওঠে কালো
পরিণত মনে ছন্দের দোলা জাগে।
স্পর্শেও যদি পাওয়া যায় এতো সুখ !
সে স্পর্শ তবে বারে বারে যেন লাগে।

ঝড়ে’র হাওয়ায় রজনীগন্ধা বনে
কতো ফোটা ফুলে পরস্পরকে ছোঁয়া
তেমনি কারো’র চঞ্চল হাত যদি
স্পর্শের তাপে আনে দক্ষিণে হাওয়া।

স্পর্শের তাপে ভুলে যাওয়া অনুভূতি
সহজেই আনে অবাক চাঁদের আলো
চাঁপার গন্ধে ভরে যাক চার দিক
তোমার মনেতে বালুচরী জমকালো।

সে মনের কোনে ফিরে আসা বারবার
রাতের আকাশে স্বাতী, স্বাহা’দের মতো
কখনো দৃশ্য কখনো হারিয়ে যাওয়া
এমন করেই ভুলে থেকো যতো ক্ষত।
__________________________
©গৌতম দত্ত

।। ওকে ঘুমাতে দাও ।।

রাজ পথ গিয়েছে  তোমাদেরই ফ্ল্যাটে  ঢুকে ।
শুধু ফুটপাথ যায়নি কোথাও !
শুধু ফুটপাথ যাদের বুকের তলে,
যাহাদের একেকটা  দুর্বল পাঁজর;
রাস্তার সোনালি আলোতে নিঃশব্দে জেগে থাকে,
আর  শ্রেণী বণ্টনের গল্প  শোনে রোজ ।
তাদের নিথর  হৃৎপিণ্ডে হাত  রেখেছে ও,
সভ্যতার কি দারুন  ভয়ানক প্রতারণায় নিথর  হয়েছে হৃৎপিণ্ড ।

তাকে ঘুমাতে দাও- ঘুমাতে দাও তাকে !
সকাল হয়েছে বলে চিৎকার করো না ।
তোমাদের মৃত আলোর সে সকাল কে ও খুবই চেনে ।
তাকে ঘুমাতে দাও ঘুমাতে দাও তাকে !

মাটির খবর নিতে গিয়ে ও ফিরেছে অনাথ লাঙল সঙ্গে নিয়ে !
একাকী শিমুল ডালে জোড়া চাষিকে দেখেছে !
দেখেছে সুজলা সুফলার কারিগর ঝুলছে নিথর হয়ে ।
পচা গলা চামড়াও মাটিকেই দিয়ে যাবে উর্বরতা;
তবুও প্রতিটি মাছি, কানে কানে গান শুনিয়েছে ওকে-
-'পুঁজিবাদ জিন্দাবাদ' পুঁজিবাদ জিন্দাবাদ' ।

অবলা সে কিশোরীর শেষকৃত্যের মতোই বিবাহ দেখেছে ।
দেখেছে নারীর  কোমল পিঠেই পুরুষের দিনলিপি ।
দেখেছে নারীর চোখে মায়ের কোমল অশ্রু ।
পুরুষের বিজয় নিশান ওর পাঁজর ভেঙেছে ।

সকাল হয়েছে বলে চিৎকার করো না !
তোমাদের মৃত আলোর সকাল কে ও খুব চেনে ।

তোমাদের সৌখিন  জানালা বন্ধ দেখে ঘুমিয়েছে  !
ওকে ঘুমাতে দাও, ঘুমাতে দাও ওকে ।।____________
© রু দ্র র বি

।। শাস্তি ।।

রুটির থালাটা শব্দ করে গারদের নিচ দিয়ে গড়িয়ে চলে এল... প্রায় রোজকার চারটে রুটি, পেঁয়াজ আর ঘ্যাঁট.. দীর্ঘ নয় বছর... কদাচিৎ সুখাদ্য...!! কাল মুক্তি বন্দীদশা থেকে... নেশার ঝোঁকে যে গর্হিত কাজ হয়ে গেছে, তার  শাস্তি ভোগ চলছে....এমনটাই ভেবেছে রাজেন..!!  পাপ করলে শাস্তি, তাই হচ্ছে, এবারটা একটু বেশি হয়ে গেল...!!
         এর আগেও অনেকবার গারদে থেকেছে... শর্ট টাইম.. এইবারে ক্যাচাল হয়েছে মেয়েটার বয়েসটা... শুধু বারো ছিল তারওপর মরে ফরে গেল..!! জজসাহেবা ইমোশানাল হয়ে নয়বছর...! যাকগে যাক, কালকে বেরিয়েই বাড়ি.... ভাত খেতে হবে... বউটা ঘেন্নায় একবারও আসেনি.... বাচ্চাটাকে একবারও আনেনি শালি.. বাড়িটা একই আছে তো.. ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে!! ধর্ষণ এবং হত্যাকান্ডের আসামী রাজেন মুক্তি পাচ্ছে কাল..!!
    পরদিন সকাল...এই জেলের মালগুলো এত ফালতু বকে... মালপত্তর দিয়ে পাওনাগণ্ডা বুঝিয়ে, সইসাবুদ করিয়ে ছেড়ে দিলেই হয়...! বাস থেকে নেমে হাঁটতে থাকে বাড়ির পথে... মাঝে বাচ্চাটার জন্যে চকলেট আর চুলের ফিতে কেনা..!! বাড়ি আসতেই শোনে বউয়ের চিৎকার.. নিজেকে শুধরে এসেছো নাকি অমানুষই আছো... আমরা ঠিক আছি.. খুব ভাল তোমাককে ছাড়া... তোমাকে আমাদের দরকার নেই...বেরিয়ে যাও.!! চুপচাপ শোনে.. ভাত খাব বলে দিয়ে স্নান করতে পুকুরের দিকে যায় রাজেন... গরম ভাত কতদিন পরে... আহা!!
        স্নান সেরে ওঠার সময় চোখ যায় পুকুরঘাটের ঝোপঝাড়ের পেছন দিকে... লাল ফ্রক.... জেগে ওঠে পুরানো প্রবৃত্তি.. হ্যাঁ চোদ্দো পনেরোই বয়েস হবে মনে হয়... বাহ মহল্লায় আসতেই ভাল কিছু...!! আস্তে আস্তে উঠে এগিয়ে যায় মেয়েটির দিকে..!!! নাহ বেশি বাঁধা দিতে পারেনি..!! মুখটাই দেখা হলনা ঠিক করে.... যাকগে যা..... দুপুরটা শুনশান.. অল্প আওয়াজ... বুঝতে পারেনি কেউ এই পাড়াগাঁয়ে...!  আর সেই ভুল করে নাকি.... শেষ করা চলবেনা একদম.. করলেই মার্ডার কেস..!! কেউ জানবেনা, ঝোপঝাড়ে ঠেলে দিয়ে  বাড়ি ফিরে চুলটা আঁচড়ান নিজের আয়নায়.. গামছাটা মেলে দিয়েই, কই ভাত দাও..!!
     কিছুক্ষণ.. ভাত দিচ্ছেনা কেন...হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচি..... হাউমাউ করছে বউটা... আরে আরে কি করে.... এর মধ্যেই জানাজানি নাকি..!! চোখে অন্ধকার.. এ তো পুকুরঘাটের বাচ্চাটা মনে হয়..  সেই মেয়েটা...এই বাড়িতে কেন... কি করে.. এখন কি করবে... কি করে বাঁচবে.... হঠাৎ বউ ঘরে ঢুকে এল উন্মত্তের মত.... দেখ তোমার পাপ লেগেছে.... এইবার কোন জানোয়ার তোমার নিজের মেয়েকে তোমার চোখের সামনে... দেখ দেখ ধম্মের কল বাতাসে নড়ে... আমার সব্বোনাশ করে দিল কে...কে করেছে... কোথায় গেছিলে তুমি... !!
      অনুভূতিহীন শব্দগুলো কান ছুঁয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে...  কেমন চারিদিক অন্ধকার ঠেকছে... মানে কি... নিজের মেয়েকে...  সামনে রাখা চুলের ফিতেটা হঠাৎ অনেক বড় হয়ে গিয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে যেন গলায়.. আহ নিশ্বাসটা কেমন বন্ধ হয়ে... ফুসফুসভরা বাতাস.. বেরোতে পারছেনা... পাঁজর ঠেলে ফেটে মুক্তি চাইছে প্রাণ...!
       পুলিশ এসেছিল.... বুঝে পায়নি জেল থেকে ছাড়া পাওয়া আসামী..... ভাত খাব বলে হঠাৎ নিজের ঘরে আত্মহত্যা.... অদ্ভুত.... ডাক্তার বলছে নিজের গলায় প্রায় বারোটা প্যাঁচ দিয়েছে লোকটা... নিজেকে এত নৃশংসভাবে কেউ.. লাশটা বের করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে... এক হাতে চকলেট আর এক হাতে লাল চুলের ফিতের অংশ..!!! একলা ঘরে সব বুঝে লজ্জায়, হতাশায় কাঁদছে রাজেনের বউ... শেষকৃতকর্মের শেষবিচার... এতদিনে ঠিক শাস্তি পেল জানোয়ারটা..!
__________________________
© অর্ণব ভট্টাচার্য

।। ফাগুনের কান্না ।।


এসেছে ফাগুন
লেগেছে আগুন
            প্রেমীর মনের দুয়ারে…
আজ আর ফাগুন রানী
গাঁথেনা সে প্রেম-কাহিনী
            ভালোবাসেনাতো উহারে!!
পলাশ ফুল সকালে
দেখো কেমন অকালে
            ঝরছে ধুলার পরে
আসেনা অলি
ফুলের কলি
            শুধু পথ চেয়ে মরে।।
কৃষ্ণচুড়ায়
নয়ণ জুড়ায়
            চায় সে অভিমানে
ভ্রমর  ভুলে
বসে না ফুলে
            ছোটেনা তার পানে !
মহুয়া ফুল
কেঁদে আকুল
            মুখ গুঁজে শাখায়
ডানায় করে ভর
আসেনা মধুকর
            বসেনা তার গায় !
আমের মুকুল
শোকে আকুল
            করেছে ভীষণ রাগ
রঙীন প্রজাপতি
ছোটেনা তার প্রতি
            করেনা আদর-সোহাগ।
===================
©মোঃ তোসিকুল ওয়ারা
রচনা কাল-15-02-2017

|| সে যে অনন্যা ||


নিশ্চুপ রাত একলা নামে জানলা গরাদ বেয়ে
ফিসফিসিয়ে বলে যেন
শোন্ না ওরে মেয়ে ----
অনেক তো হ'ল ঘরকন্না রান্নাবাটি খেলা
গড়িয়েছে নিঠুর সময়
হারিয়েছে মেয়েবেলা !
ইচ্ছেডানার পালক ছেঁটে কেটে গেছে দিন
সবাইকে রাঙাতে গিয়ে নিজেই বেরঙিন
ক্ষতমুখ সব ঢেকে রেখে প্রলেপ মলম দিয়ে
নিঃশব্দ রক্তপাত লুকিয়ে মুছে নিয়ে
ভাঙতে ভাঙতে ... গড়তে গড়তে
নিজেই গেছিস হারিয়ে ... !

আদুরী মেয়ের ডায়েরী লেখা ; খোলা গলায় গান
অকারণ হাসি পুলক ... জমা অভিমান
গোপন চিঠি ; চিলতে রোদ ; ছলাৎ প্রাণের দোলা
মনে থাকে --- কেন যে যায়না সেসব ভোলা
নিজের খাঁচায় নিজেই বাঁধা যত্নে বেড়ী
শুধু অন্তনীল আকাশে ওড়ে মন - সুদূরী !!
_________________________________
© সুচরিতা মুখোপাধ্যায়

।। কন্যাভ্রুণ ।।

মা গো আমি তোমার জঠরে
একটি কন্যাভ্রূণ -
সুপ্ত ঘুমন্ত কিন্তু আমি জীবন্ত বেঁচে থাকা ।
তুমি কি জেনেছ আমার সম্ভাবনার কথা --
মা গো তুমি কি আমাকে জন্ম নেবার
অধিকার দিতে পার -
পৃথিবীর ওই আলো বাতাসেতে আমি কি খেলব ?
মা তোমার কোলেতে তোমার আদরে
আমি কি হব বড় ?-
তুমি কি আমাকে জন্ম নেবার অধিকার দিতে পার --
তোমার রক্তে তোমার শিরায় আমার
নিঃশ্বাস আনাগোনা,
আমি অনুভূতিময় সম্ভাবনায়
একটি সুপ্ত আলো --
মা হয়ে কি তুমি নিভিয়ে দেবে গো,
করবে জঠর কালো  ?
বংশরক্ষা নাইবা হলাম প্রদীপ জ্বালাবো নারী ,
হয়ত দেখবে নিজের জঠরে বিশ্ব ধরতে পারি -
দেখনাগো মা কেমন ঘুমিয়ে একটি ছোট্ট প্রাণ ,
সে যে ধুকপুক বুকে নিঃশ্বাস নেয় মা --
মা গো সে কি শিহরণ দেয়না ?
সে কি তোমার নিজের আত্মজ হয় না ?
তাকে খুন করে বিশ্বে কি করে নিন্দিত কর মা ডাক ---
কন্যা ভ্রূণের কণ্ঠে কি গো মা
ওই ডাক বড় অভিশাপ ?
অভিশাপ গোটা নারীত্ব জুড়ে নারীর রক্তে বিষ ,
নারী না থাকলে জঠর হবে না জ্বলবেনা কোন আলো -
নারী না থাকলে এ বিশ্বধরা অভিশাপময় কালো॥
_______________
© বৈশাখী চ্যাটার্জী

।। বুক-পকেট ।।

আকাশ হয়ে যাওয়া মানুষদের খাঁচায় বন্দী করতে নেই।খাঁচার ফাঁক গলে তারা হারিয়ে গেলে চোখের নীলে তাদের বয়ে বেড়ানোর ভার সহ্য করা যায় না।
আকাশ মানুষরা দূরে থেকেই প্রিয় মানুষটার খেয়াল রাখে।প্রিয় মানুষটা 'মন কেমন করা বিকেলে' বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে  একফালি রোদ হয়ে এলো চুলের ফাঁকে গালে ছুঁয়ে দিয়ে যায়। কখনও হুট করে বৃষ্টি নামিয়ে ছাদের পদ্মপুকুরে দুপুরের বৃষ্টি বিলাশের আমন্ত্রণ অথবা মধ্য রাতে চাঁদটাকে তার জানালার আরও একটু কাছে এনে রেখে দিয়ে যায় ।
তখন হয়তো জানালার কাছে এসে দু'টি তৃষ্ণার্ত চোখ বলে....
-কেমন আছো?
-আছি... যেমন থাকে মাথার উপর আকাশ...
-সেটা কি রকম?
-আমার সস্তার গিটারটার মত। একটা ক্ষেপাটে মন আর ছয়টি তার। কখনও ভীষণ শীত...কখনও অনেকখানি ওম...কখনও ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে। এই যে জিজ্ঞাসা করলে কেমন আছি? এখন শুভ্রসাদা মেঘ... মেঘের পরতে পরতে রুপালী ফুলের আগুন। তুমি হারিয়ে গেলেই ঝড়। কাল বৈশাখী।
-কেমন আছো?
-আছি... যেমন থাকে মাথার উপর আকাশ...

স্যাটেলাইট আর আকাশ সংষ্কৃতির যুগে পকেট যোগাযোগ ব্যাবস্থায় "আকাশ মানুষ" হওয়া সহজ না।
আমি হিমু নই।আমার পাঞ্জাবীর তিনটা পকেট। দু'টো স্বাভাবিক আর একটা অস্বাভাবিক। অস্বাভাবিক এই জন্য যে আমার পাঞ্জাবীর তিন নম্বর পকেটটা হলো বুক পকেট।
এই যুগে আর কেউ বুক পকেট-ওয়ালা পাঞ্জাবী পরে না। পাঞ্জাবীর কারিগর সোলেমান ভাই,এলিফেন্ট রোডের চারুলতা টেইলর্সের মালিক কাম কাটিং মাস্টার। চারুলতা মেয়ে সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়। আগে লেডিস জেন্টস উভয়ের জন্যই চারুলতা উন্মুক্ত ছিলো।এখন শতভাগ নারীবাদি।
পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষদের বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে চারুলতার এই আচরণ একটা দৃষ্টান্ত টাইপের কিছু হতেই পারে।
মাস ছয়েক আগে একবার সস্তায় স্যান্ডেল কিনতে এলিফেন্ট রোডে গিয়েছিলাম। দোকান ঘুরে ঘুরে স্যান্ডেল দেখার এক ফাঁকে স্ট্রাটিজিক টাইমে সিগারেট ধরিয়ে মেহজাবিনের 'গায়ে মাখা সাবান' বিক্রি করা জাতীয় একটা বিলবোর্ডের নিচে দাঁড়িয়েছিলাম। সাবানের ফ্যানা ট্যানা মাখা বেশ একটা সুখী সুখী হাসি নিয়ে বাথটাবে শুয়ে থাকা মেহজাবিনকে দেখে মনে হতে পারে, পৃথিবীর সমস্ত সুখ গায়ে সাবান মেখে বাথটাবে শুয়ে থাকায়।
"সুখ নাই রে পাগলা" লিখে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া অসুখে আক্রান্তরা এই বিলবোর্ড দেখার পর আবেগী হাতে কিবোর্ড টিপে স্ট্যাটাস দিতে পারে "হ্যাপিনেজ ইজ,গায়ে ফ্যানা ফ্যানা করে সাবান মাখা"।
-রাশেদ
পিছন থেকে সোলেমান ভাইয়ের ডাকে চমকে গিয়ে তার দিকে ফিরে চাইলাম। হাতে সিগারেট থাকায় ক্ষণিক উশখুশ লাগছে।সিগারেট ফেলে দেবো কিনা সেটা ভাবছি।তিনি অবশ্য সে রকম সিনিয়র কোনো বড় ভাই না যাদের সামনে সিগারেট ফেলে দিতে হয়।আগেও কয়েকবার সিগারেট হাতে তার কাছে ধরা খাওয়া হয়ে গেছে বলে এখন আর তেমন সংকোচবোধ কাজ করে না।তারপরও যা হবার হয়ে গেছে সোলেমান ভাই হাতের সিগারেট দেখে ফেলেছে।এখন সিগারেট ফেলার নাটক করে নতুন কোনো সিন ক্রিয়েট করার মানে হয় না। তবে সমস্যা হলো সিগারেট হাতে তাকে সালাম দেওয়া যাবে কিনা সেটা নিয়ে।খাবার সময় সালাম দেবার ব্যাপারে নিষেধ আছে বলে শুনেছি।
-ভাই কেমন আছো?
-তুই এখানে?
-একটা কাজে এসেছি
বেকারদের মুখে কাজের কথা শুনতে শ্রোতারা আরাম পায় না।ভ্রু-কুচকে চেয়ে থাকে। ব্যাপারটা এমন," এ'তো বেকার! এর আবার কীসের কাজ ! নিশ্চয়ই কোনো বদমতলব মাথায় নিয়ে ঘুরছে"।
-কাজ শেষ হয়েছে?
-এখনো শেষ হয়নি
-আয় আমার সাথে
এই মুহূর্তে আমি সোলেমান ভাইয়ের সাথে তার "চারুলতা'র" ক্যাশ কাউন্টারে বসে আছি।এক ফাঁকে কোনো এক পিচ্চি দু'কাপ চা আর বিস্কিট দিয়ে গেছে।সোলেমান ভাই চায়ে ভিজিয়ে সেই বিস্কিট বেশ আরাম করে খাচ্ছে।পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্যগুলোর একটি হলো তৃপ্তি করে খেতে বসা কোনো মানুষের খাওয়ার দৃশ্য।তৃপ্তি নিয়ে খেতে বসা মানুষ দিন দিন কমে যাচ্ছে। চল্লিশার মতো একটা শোকাবহ অনুষ্ঠানের দাওয়াতেও যদি চোদ্দ পদের ডিশ সার্ভ করা হয়, তার পরেও খাওয়া দাওয়া শেষে বিরাট এক ঢেকুর তোলার পরে অতিথি বলবে "যুত হইলো না" ।
এতোটা কাছ থেকে সুন্দর যে কোনো কিছুর দিকে বেশী সময় তাকিয়ে থাকা যায় না।সুন্দর দেখতে হয় দূরে থেকে।কাছ থেকে দেখা সৌন্দর্য্য, ভেতরে কোথাও একটা ভয়ংকর ঘোর তৈরী করে। তখন আশপাশের অবিরাম ঘটতে থাকা নোংরামো নিতে পারার মতো রেজিস্টেন্স ক্ষমতা আর কাজ করেনা।
প্রতিনিয়ত গায়ে নোংরা মেখে এই বেঁচে থাকা, বেঁচে থাকাগুলো কঠিন হয়ে যায়। এই কারনেই প্রকৃতি সুন্দরের চেয়ে অসুন্দরের সৃষ্টিই, পরিমাণে বেশী করে রেখেছে।
আমি সোলেমান ভাইয়ের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে  দোকানের দিকে চাইলাম। দোকানে কাস্টমারের ভীড় ভয়াবহ পর্যায়ের। মনে হচ্ছে সমস্ত ঢাকা শহরের মেয়েরা আজ চারুলতায় এসে ঢুকে পরেছে।কাস্টমারের গিজগিজা ভীড় সামলাতে সেলস কাউন্টারে থাকা আট জনের আক্ষরিক অর্থেই ঘাম ছুটে যাচ্ছে।
- Holly Cow!!!
- মানে?
-পবিত্র গাভী!!!
-সেটা আবার কি রে?
-তোমার দোকানের অবস্থা তো ভয়াবহ!!!
-ঠিকই বলেছিস, আগের মতো আর বেচা কেনা নাই রে,বড় খারাপ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি
-বলো কি!! বেচা কিনা নেই মানে! এতো এতো কাস্টমার, এরা তবে কি?
-মেয়েদের ড্রেসিং সেন্স'র ব্যাপারে তোর কোনো আইডিয়া নেই বলেই এমন কথা বলছিস।ছোট্টো একটা এক্সাম্পল দিলেই এদের সম্পর্কে কিছুটা ধারনা পাবি।তুই "হাল্কা পাকা পেঁপে" কালার চিনিস?
-আমি পেঁপে খাই না
-এখানে পেঁপে খাওয়া বা না-খাওয়ার ব্যাপার না,পেঁপে এমন কোনো ফল না যা  মানুষের পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকবে,ব্যাপারটা হলো কালারে।
-সবুজের উপর হাল্কাভাবে হলুদ সেড টাইপের কিছু একটা হতে পারে
-তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো?
-ঠিক বলে বুঝানো যাবে না
-বেশীর ভাগ মেয়েরা কিন্তু ওই সমস্ত উৎভট কালারই ডিমান্ড করে বসে
-হুম...বিরাট মুসিবতের মধ্যে আছো দেখছি
-ঠিকই,মাঝে মাঝে মনে হয় ব্যাবসাপাতি বাদ দিয়ে বনে বাদারে চলে যাই
-বনে বাদারে গিয়ে কি করবে?গাছ থেকে হালকাভাবে পেকে থাকা পেঁপে লগি দিয়ে পেড়ে পেড়ে খাবে?
-একটা ছোটো খাটো গার্মেন্টস খুলে বসলে কেমন হয়?
-সে তো অনেক টাকার ব্যাপার
-টাকাটা কোনো ব্যাপার না,আমি এই মুসিবতের গুদাম থেকে মুক্তি চাইছি
-ভালোই হয়,তবে সেখানেও যদি বায়ার হালকা পাকা পেঁপে কালারের জিন্স, টপস এগুলোর অর্ডার করে বসে?তখন?
-এ কি! তুমি এখানে?
দোকানে ভীড়ের মধ্যে সাহানাকে আগেই দেখতে পেয়েছিলাম।তাই এখন সাহানা আমাকে এখানে হঠাৎ দেখতে পেয়ে যতটা অবাক হয়েছে, আমি ঠিক ততটা অবাক হইনি। অবাক হওয়া প্রিয়মানুষেরা চায় তাকে অবাক করে দেয়া মানুষটাও তার মতোই অবাক হোক।আমি অবাক হবার ভান করে বললাম...
-OMK!! তুমি এখানে!!!
সোলেমান ভাই হঠাৎ ঘটে যাওয়া এই মিলনাত্মক পরিস্থিতির মধ্যে ফেসে গিয়ে তব্দা মেরে গেছেন। তার এখন কি বলা উচিৎ বা করা উচিৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। চায়ে বিস্কিট ডুবিয়ে রেখে একবার সাহানার দিকে একবার আমার দিকে চাইছেন।হাতে ধরা বিস্কিট গলে অর্ধেক ভেঙে চায়ের কাপে পরে গেছে।বাকি অর্ধেক বিস্কিট তিনি হাতে ধরে রেখেছেন।
-এখানে কি করছো?
-যাঃ বাবা! এখানে আমার কোনো কাজ থাকতে নেই বুঝি?
-মেয়েদের টেইলারিং শপে তোমার কোনো কাজ থাকার কোনো যুক্তিগত কারণ আছে বলে তো আমার মনে হয়না

-তা ঠিক,তবে সাহানা,তোমার বক্তব্যে কিঞ্চিৎ ভুল আছে
-মানে?
-মানে মেয়েদের টেইলারিং শপে ছেলেদেরও কিন্তু অনেক কাজ থাকতে পারে
-কি বলতে চাইছো?তুমি এখানে চাকরী নিয়েছো নাকি!
-ব্যাপারটা ঠিক তাও না,আমি এখানে মাঝে মাঝে চা বিস্কিট খেতে আসি।বড় হয়ে যাবার পর চায়ে ডুবিয়ে বিস্কিট খাবার মতো ব্যাপারটা সব জায়গায় করা সম্ভব হয় না।লোকজন আড় চোখে চেয়ে থাকে।মনে মনে বিদ্রুপের হাসি হাসে।এই রকম একান্ত কিছু ব্যাক্তিগত ছেলেমানুষি ছেলেবেলার কাছের মানুষদের আশেপাশে থেকেই করতে হয়।তাই এখানে আসা।
-তোমার এসব উদ্ভট কথার কিছুই আমি বুঝতে পারছিনা
-উদ্ভট কথা আপাতত ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে দাও।উনার সাথে পরিচিত হও।ইনি সোলেমান ভাই,আমার কাজিন
-স্লামালেকুম ভাইয়া
সোলেমান ভাই বেশ ভালোই অবাক হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।সালামের উত্তর দেবার বদলে তিনি কপ করে বিস্কিট মুখে পুরে চিবোতে লাগলেন। তারপরই ভুল বুঝতে পেরে মৃদু ফ্রিকুয়েন্সির হে হে জাতীয় একটা শব্দে হাসার চেষ্টা করলেন।এই ক্ষেত্রে অবশ্য সাহানারও কিঞ্চিৎ ভুল আছে সে বিস্কিট খেতে থাকা অবস্থার একজন মানুষকে সালাম দিয়ে ফেলেছে।
-তোরা গল্প কর আমি একটু বাইরে থেকে আসছি,সাহানা, তুমি এখানটায় এসে বোসো
সোলেমান ভাই তার চেয়ারে সাহানাকে বসিয়ে বাইরে চলে গেলেন। অবস্থাভেদে চেয়ারের নিশ্চই আলাদা কিছু ক্ষমতা আছে। শুধুমাত্র একটা চেয়েরে বসার কারণেই কোনো একটা মানুষের ব্যক্তিত্যে গাম্ভীর্য্য চলে আসতে পারে,আবার গম্ভীর কাউকে অতিমাত্রায় ফাউলও মনে হতে পারে ।
এই মুহূর্তে সোলেমান ভাইয়ের চেয়ারে বসা সাহানাকে দেখতে অন্যরকম লাগছে।দোকানের বসের চেয়ারে বসার কারণে সে বোধয় সাময়িক ভাবে নিজেকে বস বলে মনে করে থাকতে পারে। সোলেমান ভাইয়ের মত করেই সে একটু পর পর ঘাড় কাৎ করে সেলস কাউন্টারের দিকে চাইছে।যেন সোলেমান ভাই "বাবুর হাটে" যাবার সময় তাকে দোকান সামলানোর জন্য ক্যাশে বসিয়ে রেখে গেছেন।ব্যাপারটা দেখতে বেশ মজাই লাগছে।
পিচ্চি আবারো চা বিস্কিট নিয়ে ডেক্সের উপর সাজিয়ে দিয়ে গেছে। সাহানা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে গম্ভীরভাবে কিছু সময় চায়ের কাপের দিকে চেয়ে থেকে একটা চুমুক দিলো।
-চা খাচ্ছো না কেনো?
-একটু আগেই এক কাপ খেয়েছি
-আবার খাও,চা প্লেট ভরা ভাত তরকারি না যে এক বেলায় দু'বার খাওয়া যাবে না,খাও
-ইয়েস ম্যাম
-ফাজলামো করবে না
-যা বাবা! ফাজলামো কখন করলাম!আমি সিরিয়াসলি বললাম তো
-আশ্চর্য্য, আমি তোমার ম্যাম হতে যাব কোন দুঃক্ষে!
-সোলেমান ভাইয়ের চেয়ারে বসার পর থেকেই তোমাকে দেখতে দোকানের মালিক বলে মনে হচ্ছে।মানুষের সবচেয়ে বড় ডিসএডভান্টেজটা হলো সে আয়না ছাড়া নিজেকে দেখতে পায় না।আর আয়নার সামনে দাঁড়ালেও স্বাভাবিক এক্সপ্রেশনগুলো দূরে সরিয়ে রেখে নিজেকে দেখে।তারপরেও এখন যদি একটা আয়না তোমার সামনে এনে ধরতে পারতাম তাহলে হয়তো বুঝতে পারতে আমি সত্যি বলছি কিনা
-দোকান মালিক হবার কোনো রকম ইচ্ছে আমার নেই,দেখি ওঠোতো
-কেনো!কি হলো আবার?
-আমি আর এই চেয়ারে বসতে পারবো না।তুমি বলার পর থেকে নিজেকে আসলেই কেমন যেন দোকানদার বলে মনে হচ্ছে।এখানে এসে বসো, আমি তোমার চেয়ারে বসবো
-হা হা হা...
-হাসছো কেনো!আমি কি হাসার মতো কিছু বলেছি
-সাহানা,সোলেমান ভাই ভালোবেসে কিছু সময়ের জন্য তোমাকে তার উত্তরাধিকার মনোনীত করে গেছেন,ফিরে এসে যদি দেখে তুমি তার সেই ভালোবাসা অন্য কাউকে দিয়ে দিয়েছো তাহলে সে দুঃখ পেতে পারে,এন্ড ফর ইয়োর কাইন্ড ইনফরমেশন তুমিই প্রথম মানুষ যাকে সোলেমান ভাই এই চেয়ারে বসতে দিয়েছে।
সেদিন সাহানা আমার জন্য কাপড় কিনে এই তিন পকেটের পাঞ্জাবী বানিয়ে দিয়েছিলো। সোলেমান ভাই তার নীতি থেকে সরে এসে নিজেই আমার বুক পেট কোমরেপ মাপ নিয়ে ফস ফস করে কাপড় কাটতে কাটতে বলেছিলো "যাহঃ বিকালে এসে পাঞ্জাবী নিয়ে যাস "। বিকেলে সোলেমান ভাই দোকানে ছিলো না।আমি তাড়াহুড়ো করে পাঞ্জাবী নিয়ে চলে গিয়েছিলাম। রাতে বাসায় ফেরার পর পাঞ্জাবীতে এই ৩য় পকেটের অস্বিত্ব আবিষ্কার করি।
বাইরে বেড়োবার জন্য কিছু একটা খঁুজছিলাম। সবকটা শার্ট, গেঞ্জির করুণ অবস্থা।লণ্ড্রীতে না পাঠালেই নয়।এখন এই তিন পকেটের পাঞ্জাবীটাই শেষ ভরসা হিসাবে পরতে হয়েছে।
-রাশেদ ভাই
-বল
-কোথাও যাচ্ছেন?
-হ্যাঁ
-সাহানা আপু সকাল থেকে আপনাকে ফোনে ট্রাই করে যাচ্ছে
-ও
-রাশেদ ভাই
-আবার কি?
-একটু যদি ফোনটা রিসিভ করতেন
-পরে
-তাহলে আমি এখন কি করবো?
-তুই কি করবি তার আমি কি জানি...
-আপু আবারোটও ফোন করলে আমি তাকে কি বলবো?
-কিচ্ছু বলতে হবে না
-এটা আবার কেমন সমাধান!
-এককাজ কর,তুই তোর ফোন বন্ধ করে রাখ
-পারবো না,আমি ফোন রেখে যাচ্ছি, আপনার যেটা ভালো মনে হয় আপনি করেন।
রাফসান ওর ফোন আমার খাটের উপর ফেলে রেখে চলে গেছে। আমার অবস্থা  "এই যন্ত্র লইয়া আমি এখন কি করিবো" টাইপের। চাইলেই সাহানাকে ফোন করা যায়। বলাই যায় "কেমন আছো সাহানা"? এই প্রশ্নটা পৃথিবীর সব থেকে অর্থহীন প্রশ্ন। অথচ একটা জীবন কম পড়ে যায় এটার অর্থ জানতে গিয়ে..."কেমন আছি"।
আজ কেন জানি সাহানাকে কিছুই বলতে ইচ্ছা করছে না।এই সমস্ত অনিচ্ছার কোনো কারণ থাকে না। প্রিয় মানুষগুলো হলো এক একটা প্রজাপতি। প্রজাপতি হাতের মুঠোয় বন্দি রাখতে নেই। তাদের উড়িয়ে দিতে হয়। আমি মাঝে মাঝেই প্রিয় মানুষগুলোকে উড়িয়ে দিই। গভীর আগ্রহে তাদের উড়াউড়ি করা দেখি। কিছু কিছু প্রিয় প্রজাপতি উড়ে অনেক দূরে  চলে যায়। তারা আর ফেরেনা। আমি আর্দ্র চোখে প্রিয় প্রজাপতিদের চলে যাওয়া দেখি।
অনেকগুলো রঙিন বিকেল কাটানো গল্প ডানায় জমিয়ে কিছু প্রজাপতি হুট হাট করে ফিরে আসে। তখন এক ধরনের আনন্দ হয়।
আমি সেই আনন্দ আমার পাঞ্জাবীর বুক পকেটে খুব যতনে এক গোপন চিঠির মতো রেখে দিই। যার প্রতিটা লাইন জুড়ে আছে ভীষণ রকম শিহরনের এক একটি অজানা গল্প। আমি আলতো করে এক একটা লাইন ছুঁয়ে যাই... আর ভাঁজ খুলে যাই এক একটা অক্ষরের।।
__________________
© মোহাম্মাদ সামি