Sunday, 5 March 2017

।। অন্যা ।।



বিয়ের পরদিন শ্বশুরবাড়িতে অন্যা। সব আচার অনুষ্ঠানের পর জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে বিরাট বড় ঘরটার বিরাট খাটের একপাশে। এই ঘরটাই নাকি তার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে! বড়লোক শ্বশুরবাড়ি তার বাবার কাছ থেকে কিছুই নেয়নি, তারা শুধু সুন্দরী-শিক্ষিতা পাত্রীটিকে চেয়েছিল। কিন্তু এ বাড়িতে পা রেখেই সে দেখেছিল বাড়ির আত্মীয়াদের চোখে চাপা কৌতুক আর মাঝেমধ্যে কানে ভেসে আসছিল কিছু টুকরো কথা। তার বড় অসহায় লাগছিল। ঘরের আলো নিভলে রাতে তার দুচোখে সব অভিমান উথলে উঠলো। মনে পড়লো এই বাড়ির সেই বৃদ্ধা আত্মীয়ার কথা- জোরে জোরে যে সকলের সামনে সন্ধ্যেবেলায় বলে উঠেছিলো -
"হ্যাঁরে নাত বৌ, তোর গয়নাগুলো নাকি সবই নকল! সকলে বলাবলি করছে! বলি তোর বাপের কী কোনো আক্কেল জ্ঞান নেই! এতো বড় বাড়িতে মেয়েকে বিয়ে দিল কি করে এমন নির্লজ্জের মতো! একটুকরো সোনা জোটেনি! আমরা না হয় কিছু চাই নি, তাই বলে এভাবে মেয়েকে পাঠায় কেউ!"
অন্যার কান-মুখ রক্তের চাপে যেন ফেটে যেতে চাইছিল। ঘিরে থাকা বাকিদের চাপা হাসির মধ্যে ও শুধু কান্নাটাকে সামলাতে চাইছিল। মুখে কোনো ভাষার জোগান ছিল না।
এখন সে ভাবছে আর ভেবেই চলেছে "একটা মানুষ ও খোঁজ নিল না, জানতেও চাইলো না আজ কেন তাকে এমনভাবে আসতে হয়েছে! অথচ এরা সবাই জানতো যে তার বাবা অনেকদিন ধরে অসুস্থ আর তার চিকিৎসা করিয়ে তারা এখন নিঃস্ব। এমন অবস্থায় মায়ের দেওয়া গয়নাগুলো যদি ও নিয়ে আসতো তাহলে ওদের বাকী দিন চলতো কেমন করে!"
কাউকে 'নতুন বৌ অন্যা' জানাতে পারলো না যে ঐ গয়না কটাই এখন অন্যার মায়ের শেষ সম্বল-  ওগুলোর ভরসাতেই ওর মা এখন বাবাকে সুস্থ করার বাকী লড়াইটা চালাবে। অন্যার এটাও জানালো হলো না যে ওর বোনটাকে এখনো তিন-চার বছর পড়াতে হবে----- জানানো হলো না কাউকে আরো অনেক কিছুই------

অন্যা অন্ধকারেই চোখের জল মুছে উঠে বসলো-
অপমানগুলো সব ভুলে গেল মা-বাবা আর বোনটার মুখ মনে করতে করতে। এক চিলতে হাসি খেলে গেল তার মুখে- বড় তৃপ্তির হাসি ছিল সেটা।
নিজেকেই নিজে বললো,"মা যদি এতো কষ্ট সহ্য করতে পারে তাদের মানুষ করার জন্য, এতো ধৈর্য নিয়ে বাবার সেবা করতে পারে, তবে কটা গয়নার জন্য সে-ই বা এই তুচ্ছ কথাগুলো গায়ে মাখবে কেন!
সে এবার পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো নিজেকে একটা বলে- "যা করেছি, একদম ঠিক করেছি।
বাবার দেওয়া নামটাকে সার্থক করারও তো একটা দায় তার আছে - বাবা যে তাকে 'অন্যা' বলে ডাকে সেটা সে 'অন্য রকম' বলেই তো! নাকি!
_________________________
© সঞ্চিতা দাস মজুমদার


No comments:

Post a Comment