Sunday, 5 March 2017

।। স্তাবক ।।



মুঘল সাম্রাজ্যের সূর্য্য তখন মধ্য গগনে। সম্রাট আকবরের শাসন সারা ভারতবর্ষ । আকবরের দরবারে নবরত্ন সভার জ্ঞানী গুনি জনের নাম দেশ দেশান্তরে উচ্চারিত হয় বাংলা দেশের এক প্রান্তিক রাজা ছিলেন পুণ্ডরীকাক্ষ। রাজা পুণ্ডরীকাক্ষ যতই ছোট রাজা হন না কেন , উচ্চাশা কোনো সম্রাটের চেয়ে কম নয়। সম্রাট আকবরের নবরত্ন সভার কথা শুনিয়া পুণ্ডরীকাক্ষও তাঁর দরবারে নবরত্ন সভা বসিলেন । খুঁজে পেতে বিভিন্ন শিল্প কলা , সঙ্গীতে, শাস্ত্রে যারা নিজেদের স্থান করে নিয়েছে তাদেরকে আমন্ত্রণ করে নিজের রাজপ্রাসাদে রাখলেন। তারা সারাদিন খায়দায় ও ঘুমোয়। কেবল সন্ধ্যা হলে নিজেরা বেশবাস ঠিক করে হাজির হয় পুণ্ডরীকাক্ষর রাজ সভায়। রাজা তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন , বিভিন্ন বিষয়ে নবরত্নের প্রতিটি বিজ্ঞজন নিজের নিজের ব্যাখ্যা দিতে থাকেন। রাজা পুণ্ডরীকাক্ষ সব শোনার পর নিজের মন্তব্য প্রকাশ করতেন।

নবরত্নের সবাই ভালো করে জানে রত্নের শোভা আলোকের প্রতিফলনে। আলোর প্রকাশ না থাকিলেরত্নের শোভা নিমেষে উধাও হইয়া যায়। সেই আলোক বর্তিকাকে জ্বালিয়ে রাখার দায়িত্ব যে নবরত্ন সভার সকল সদস্যের কর্তব্য সে বিষয়ে তাহাদের কোনরূপ সন্দেহ ছিলনা। কাজে কাজেই নবরত্ন সভা পরিনত হলো স্তাবক সভায়। রাজার সকল মন্তব্য , সকল উপস্থাপনকে স্তুতি দিয়ে স্বাগত করা শুরু হলো। রাজার সেই মন্তব্য , নবরত্নসভার প্রশংসার দরুন , তাহাই নিয়মে পরিনত করতে মন্ত্রী সান্ত্রীরা উঠে পড়ে লাগলো। রাজা যদি দু লাইনের কবিতার প্রশংসা করেন , নবরত্ন সভা তাহাদের প্রশংসার চাপে সারা দেশে দুই লাইনের কবিতা লেখার আইন পাশ হলো।

তেমনি রাজা পুণ্ডরীকাক্ষ একবার বামন মূর্তির প্রশংসা করার দরুন , সারা দেশের কেবল বামন মূর্তি তৈরির আইন পাশ হয়ে গেলো। শিল্পীরা কেবল বামন মূর্তি বানানোতে উঠে পড়ে লাগলো। সারা দেশে রাজা পুণ্ডরীকাক্ষর পিতা , প্রপিতামহর যত পূর্ণ অবয়বের মূর্তি বসানো হয়েছিল , নতুন আইনের চাপে সেই সব মূর্তি সরিয়ে নেওয়া হলো। তার জায়গায় বসানো হলো সব বামনাকার মূর্তি। রাজা একদিন সকালে প্রদেশ ভ্রমনে বেরিয়ে দেখলেন তাঁর সব পূর্ব পুরুষেরা রাজার নিজের প্রশংসার ঠেলায় বামনাকৃতি ধারণ করেছে ।
সেই সময়ে বীরবল আকবরের দূত হিসাবে রাজা পুণ্ডরীকাক্ষর রাজ্যে পরিদর্শনে এসেছেন । তখন রাজা পুণ্ডরীকাক্ষ কথায় কথায় জানালেন পারিষদ গণের স্তুতির ঠেলায় কিভাবে তাঁর পূর্ব পুরুষেরা বামনাকৃতি রূপ ধারণ করেছে । এই স্তাবকদের হাত থেকে মুক্তির উপায় জানিতে চাইলেন রাজা পুণ্ডরীকাক্ষ। পরদিন বীরবল রাজ সভায় রাজার নবরত্নের সহিত দেখা করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। সভায় সম্রাট আকবরের নবরত্নের মহারত্ন বিরবলকে দেখে রাজা পুণ্ডরীকাক্ষর নবরত্ন সাধু সাধু করতে লাগলো । সেদিন এক গ্রামের মৃত্শিল্পী রাজার দরবারে রাজাকে এক ছোটমানুষের মূর্তি ভেট দিয়ে গেল । মূর্তিটির বৈশিষ্ট হলো , এর মোটে  একটাই চোখ । অন্য চোখের কেবল গর্ত আছে , তাতে চোখ নাই। তখন বীরবল রাজার কানে কানে কিছু বললেন । রাজা এরপর একচক্ষু মূর্তির ভূয়সী প্রশংসা করলেন। রাজার কথায় তাল মিলিয়ে নবরত্নের দল ঘোষণা করল যে মানুষের সোন্দর্য্য কেবল তাহার এক্চক্ষুতে আছে। দুই চোখ মানুষের রূপ সৌন্দর্য্য ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয় । কাজে কাজেই মানুষের একটি চোখ অনাবশ্যক।

তখন আবার বীরবল রাজা পুণ্ডরীকাক্ষর কানে কানে কিছু বললেন । রাজা পুণ্ডরীকাক্ষ ঘোষণা করলেন যে এক চোখেই যখন মনুষ্যের রূপ পূর্ণ বিকশিত হয় , তখন রাজাও তাঁর নবরত্নকে একচক্ষু রূপে দেখতে আগ্রহী। রাজা ইচ্ছা প্রকাশ করলেন যে পর দিবসে যেন সব নবরত্ন নিজ নিজ এক চোখ তুলে ফেলে দিয়ে রাজ দরবারে উপস্থিত হয়।
সেই রাত থেকে নবরত্নের সব সদস্য নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছে । তাদেরকে আর কেউ কোনদিন রাজা পুণ্ডরীকাক্ষর রাজ্যে দেখতে পায়নি।

তাদের উত্তরাধিকারদের দেখতে পাওয়া যায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল , সাহিত্য সংস্কৃতির মঞ্চ ও বিভিন্ন দল, গোষ্ঠী বিশেষে। বর্তমান যুগে এদের নব নামকরণ হয়েছে স্তাবক , যারা মূলত দলপতিদের স্তুতি জয়গান করে থাকে। ইহারাও রবীন্দ্রানুরাগী। ইহাদের জীবন দর্শন
"করিনু প্রনাম তোমারি চরণে
মুখরিত হোক তব স্তব জয়গানে।”

এই স্তবক প্রজাতির মানুষ শিক্ষা দীক্ষায় বেশ পারদর্শী , বিদ্যা বুদ্ধিতে সাধারণের ধরা ছওয়ার অনেক উর্ধে। স্তব আর স্তাবকতা ইহাদের মজ্জাগত। ইহাদের কথা ভাবিয়া চানক্য তাহাঁর শ্লোকে উপমার ছলে বলিয়াছেন
"যস্য নাস্তি স্বয়ং প্রজ্ঞা শাস্ত্রং তস্য করোতি কিম্"।
________________________
© সনৎ মিশ্র

No comments:

Post a Comment