Wednesday, 19 April 2017

।। যদি জানতে ।।


যদি জানতে-- কতটা জুড়ে থাকো তুমি--!
যদি জানতে-- তোমার না থাকা কতটা শূন্যতা---!
যদি বুঝতে--- চোখের জলের গভীরতা কতখানি!
তোমার সৌভাগ্য, তোমাকে মাপতে হয়না আকাশ
আর বুকের মধ্যিখানে শূণ্যতার সমানুপাত কত--!
সমুদ্র আর চোখের জলের গভীরতার ফারাক কতখানি!
সময় তোমার পাগলা ঘোড়া, সাফল্যের চাবুকে
ছোটে দিক্বিদিক জ্ঞানশূন্য----
নিস্তব্ধ রাত্রে ঘড়ির কাটার টিক টিক শব্দের সাথে হৃদপিন্ডের ধ্বক ধ্বক শব্দ তোমাকে মেলাতে হয় না।
তাই তুমি পারো সহজেই ডানা মেলে দিগন্ত পেরিয়ে
যেতে, এক আকাশ থেকে অন্য আকাশে মেঘের মত হারিয়ে যেতে।
পাহাড়ের কান্না দেখে তাই তোমার চোখ জুড়ানো
ঝর্ণা মনে হয়--- এক পৃথিবী ভালোবাসা এক নিমিষে
হাওয়ায় মিশে যায়।
যদি তুমি জানতে---- কতটা জুড়ে তোমার পরিমান-----
-----------------
© মাহমুদা রিনি

।। সতীত্বের পর্দা ।।


নারী তোমায় বলছি ...
তোমার সতীত্বের পর্দাখানি আছে তো অক্ষুণ্ণ?
হয়নি তো প্রাক্-বিবাহ মিলনে তা ছিন্ন?
কিংবা জোরপূর্বক বলাৎকারে তা বিচ্ছিন্ন ?
সতীত্ব যে তোমার মাপকাঠি...
সেটা দিয়েই আমরা পুরুষজাতি
যুগ-যুগান্তর ধরে যে তোমায় মাপি ....

বিবাহোত্তর সতীত্ব যদি হয় লাল রক্তে রাঙা,
সে যে পরম সৌভাগ্য তোমার ...
নতুবা সবার কাছে তুমি বারেবারে পাবে শুধু ধিক্কার ৷
কুলটা রমনী তুমি, হবে সবে সোচ্চার,
অগ্নিপরীক্ষা তোমায় দিতে হবে বারেবার |

পুরুষ তোমার পুরুষত্বের পর্দাখানি আছে কি কোথায় লুকানো ?
নারীর সতীত্ব ছিন্নকারী পুরুষ তুমি নিস্পাপ কেন ?
অসতী রমনীর মতো পুরুষ তুমি
হবে না কেন অপুরুষ, ঘৃণাভারে ছিন্ন-ভিন্ন ?
_________________________________
© ফিরোজ আখতার

।। বিদায় ।।



তবে চলি আজ...
একদিন দেখা হবে অন্তিমলগ্নে ,
হয়ত তখন শান্তিময় চিরনিদ্রায়
সবকথা রয়ে যাবে বাকি....
তাই আজ বলে যেতে চাই......
কেন এত ফাঁকি ?
সেদিনও তো এসেছিলে
হাতে ছিলো ঝরা বকুলের ফুল
কিছুটা গন্ধ তার সাজিয়েছ উপহার করে
বাকিটুকু নিয়ে গেলে
ভালবাসা রয়ে গেলো বাকি.....,
কত রাত ভেবেছি তোমায়
ওই ঝরা ফুল গুলো যে গন্ধ দিয়ে গেলো
সেই গন্ধে অপেক্ষার প্রহর গুনেছে ভোর,
তাই বুঝি ভুল করে আজ ফাগুনের শেষে
চৈতি হাওয়ার বেসে তুমি এলে ?
আজ ঝরা ফুল নেই হাতে....
সাজিয়েছ ভালবাসা ফুলের মালাতে
জানি শুধু ভুল....
ভুল পথে এলে তুমি আজ ,
ভালবাসা সেও কি গো ভুল ছিলো ?
শুকনো ফুলের মত ঝড়ে গেলো তাই  ---
শুধু আসা যাওয়া একটি মনের মাঝে ,
প্রেম কত নিদারুণ তুমি....,
মন কত অসহায়..
আবেগের স্রোতে ভাসে
ঝরা বকুলের গন্ধ আজও তাই ,
এ জীবনে আর নয় চলি তবে
যতটুকু দিলে..শুধু সেইটুকু নিয়েছি আমি ,
না সে কোন প্রাপ্তি নয় --
শুধু হারানোর কথা ,
তবু নিয়ে যাই পড়ে থাক
কিছুটা কান্না আজ চৈতির শেষে...,
সেই অন্তিমলগ্নে এসে কোন ফাগুন হাওয়া
যদি ছুঁয়ে যায় তোমায়...
সেই কান্নায় ভিজে
আমার বুকের পাঁজর খানি আমি দিয়ে যাব....,
ধোঁয়ার আগুণে মিশে দেখা হবে সেই শেষে..।।
__________________________________
© বৈশাখী চ্যাটার্জী

।। কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে! ।।

          'কত্তা' নামক এক অতি দুর্বোধ্য ও আনাড়ি ব্যক্তিকে লইয়া এ যাবৎকাল ঘর করিতেছি। তাহার প্রতি অসীম শ্রদ্ধা রাখিয়া কহিতেছি, এমনতর অদ্ভুত মনুষ্য জীবনে দেখি নাই। যাহার বাক্য স্ফুরণ নিমিত্ত আমি ও কন্যা নিরন্তর সাধনা চালাইয়া থাকি, কিন্তু স্বল্প ব্যয়ে বিশ্বাসী তিনি 'কথার মূল্য'ও বুঝি বা 'দুর্মূল্য' জ্ঞান করেন। অতএব , এ হেন মনুষ্যের পছন্দ বা অপছন্দ সম্বন্ধীয় কোনো তথ্য উদ্ধার আমাদিগের নিকট এক অতি দুরূহ কার্য।
      এ হেন কত্তাকে লইয়া অদ্য সন্ধ্যায় যাইতে হইবে তাঁহার পরিধেয় বস্ত্র ক্রয় করিতে।একটি রুমাল কিনিতেও তিনি আজ অবধি কোন দূরদর্শিতা দেখাইতে পারেন নাই। পাঁচটি জিনিস ক্রয় করিতে দিলে কম সে কম তিনবার বাজারে ছোটেন। অন্যথায়, বাজারে পৌঁছানো মাত্র উনি মুঠোফোনে সব দ্রব্যের ধারা বিবরণী দিবেন আর জিজ্ঞাসা করিবেন যে কোনটা কতোটা আনিবেন। প্রদত্ত দ্রব্য তালিকা হারাইয়া ফেলেন। ফোনে বার্তা পাঠাইলেও সেই ধারা বিবরণী চলিতে থাকে। বস্ত্র ক্রয় করিতে কয়েকবার একা পাঠাইয়া ছিলাম (কাহাতক আর ট্যাঁকে লইয়া ঘোরা যায়!) ওমা! কিছুই মনস্থির না করিতে পারার দরুণ কিছু না খরিদ করিয়াই প্রতি বার পলাইয়া আসেন। এইরূপে জুতা পর্যন্ত কিনিতে হইলে তিনি আমাদিগের সহিত সুবোধ বালক সাজিয়া রওনা দেন। দোকানে প্রবেশ করিয়া তিনি ঘন্টা দুই অতিবাহিত করিয়া নানা প্রকার বস্ত্রাদি দেখিয়া বেড়ান এবং গুরু গম্ভীর মত প্রদান করেন রং, কাপড়ের গুণমান , মূল্য ইত্যাদি বিষয়ে। আমি ও অবলা কন্যাটি একপার্শ্বে দন্ডায়মানাসন অবস্থায় প্রভূত ধৈর্য সহকারে সেইসব জ্ঞান শ্রবণ করি, নচেৎ বিরক্তি প্রকাশ করিলে মনুষ্যটি অভিমানগ্রস্থ হইয়া কিছু ক্রয় না করিয়া হাঁটা দিবেন গৃহাভিমুখে । অতএব তাহাকে মনোক্ষুন্ন না করিয়া অবলা সাজিয়া আমরা সমুদয় সহ্যশক্তির পরীক্ষা দিতে থাকি। এক সময় মহাশয়ের বিপনী ও বস্ত্রাদি সম্বন্ধীয় যাবতীয় জ্ঞান নিঃশেষিত হইলে উনি রণে ক্ষান্ত দেন ও 'বরাবর জানা' একখানি বিবৃতি পেশ করেন, " কি হলো! তোমরা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলে কেন! বলবে তো আমি কি কি কিনবো? পছন্দ করে না দিলে আমি বুঝতে পারি না, সব এক রকম লাগে, আমার কি ছাই মনে থাকে আমার কোন কোন রংএর জামা প্যান্ট আছে? তোমরা যদি দেখে না-ই দেবে তাহলে আমার সঙ্গে এলে কেন!" ইতিমধ্যে কব্জি উল্টাইয়া আমাদিগকে সচকিত করিয়া আরো একটি বাণী দেন, "ঈস্ কতো দেরি করিয়ে দিলে! মেয়েদের শপিং এ এতো সময় লাগে কেন কে জানে!" আমি ও কন্যা পরস্পরের মুখে চাই নির্বাক চলচ্চিত্রের ন্যায়। অতঃপর, আমরা মা ও মেয়ে পনেরো মিনিটের অভিযানে তাঁহার মাপ অনুযায়ী বস্ত্রাদি আনিয়া তাহার সমীপে হাজির করি। উনি বিশেষ কক্ষে প্রবেশ করিয়া একটি একটি করিয়া পরিধান করেন ও আমাদের দেখান যে ঠিক হইয়াছে কি না। আমরা সেই কক্ষের সামনে পুনরায় দন্ডায়মানাসন অনুশীলন করি। অন্য পুরুষেরা ভারি কৌতুহলী চক্ষে আমাদের নিরীক্ষণ করেন। কখনো এমনতর শুনিতে হইয়াছে, "মাদাম, মেয়েদের জন্য কক্ষ ঐ দিকে, এখানে শুধু পুরুষদের জন্য ব্যবস্থা।" আমি আর কী বলি! নির্লিপ্ত মনে সকল কথা হজমিগুলি দিয়া হজম করিয়া ফের দন্ডায়মানাসনে ধ্যানকর্মে মন সন্নিবিষ্ট করি। বলা হইয়া উঠে না আর যে, "পতিসেবায় ( এখানে 'সেবা' অর্থ service) আমি বর্তমানে নিযুক্ত।"

           যাহা হউক, পছন্দ ও খরিদারি সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত আমি ও কন্যা অবশ্যম্ভাবীরূপে ক্ষুধা পিরীত হইয়া পড়ি এবং তৎসহ তিনিও। অতএব, কোনো ভোজনালয়ে গমন পূর্বক প্রভূত উদরপূর্তি করিয়া হাস্যমুখে গৃহে প্রত্যাবর্তন করি।

            একটু ধৈর্য ধরুন, এখনো সমাপ্তি হয় নাই। আপন গৃহে ফিরিয়া আয়নার সম্মুখে এক একটি নূতন বস্ত্র পরিধানপূর্বক তিনি খুশিতে ডগমগ হইয়া স্বগতোক্তি করেন , "বাহ্! চমৎকার মানিয়েছে। দেখেছো আমার পছন্দটা কেমন!" এহেন আত্মস্তুতিতে কন্যা যৎপরনাস্তি বিমর্ষ হইলেও আমার আর কোনো নূতন অনুভূতি জাগে না, কারণ এই সকলই আমার অবগত। শুধু একটু মৃদু হাসিয়া ভিন্ন কক্ষে গমন করি কন্যা ও মাতা পরস্পরের পদ-চর্চা করিবার নিমিত্তে।।

(পুনশ্চঃ 😂😂😂😂
           চোখের জল চোখে রাখিয়া, নাক টানিয়া শেষ বিবৃতি টুকু রাখিয়া যাই- অদ্যপি তেনার স্বভাব বদলাইলো না। অদ্য যথারীতি দুইটি T-shirt ও দুইটি shirt বাছিতে ও পরিধান করিয়া মানানসই হইল কিনা পরীক্ষা করিতে পুরা এক ঘন্টা কালক্ষেপ করিয়াছেন এবং শপিং মলের সর্পিল রেখার লেজে দাঁড়াইয়া দাম চুকাইতে আরও দুই ঘন্টা অতিবাহিত করিয়াছেন। বসিবার স্থানের আকাল হেতু অবশ পা দুইটি লইয়া মাতা ও কন্যা ভাবিতে শুরু করিলাম কে কাহার কোলে চড়িব এবং গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়া কে কাহার পদ মর্দন করিব।
কিন্তু আজ তিনি কিঞ্চিত দয়াপরবশতঃ হইয়া রাত্রির খাদ্য ভাত-মটন গরম করিয়া পরিবেশন করিলেন এবং একবাটি করিয়া আইসক্রীম ও পাইলাম বোনাস হিসেবে। আহা কী দয়ার উদ্রেক হইল! মোর পদযুগলে একটু volini spray ও করিয়া দিলেন। )

অথঃ বস্ত্র-ক্রয়-কথা সমাপ্তম্।😪😪😪
-------------------------
© সঞ্চিতা দাস মজুমদার

।। সেমিপ্লাস্টিক ন্যুড ম্যাগমা ।।

পা থেকে মাথা পর্যন্ত    পিয়ানোর রিডের মতোই
                  ফুলে যাচ্ছে তোমার কাচচেরা শরীর
            আমাদের মধ্যে এখন টরিচেল্লীর ভয়েড্

অস্পষ্ট আওয়াজ              খুঁড়ে ফেলেছো কবর
   কয়েকটা দরজার আড়াল          কয়েকটা বন্ধ
  ঘড়ির কাঁটারা থামার আগেই     কমলা সোহাগ
       লেবু গন্ধা পার্ফিউমে খনিজ ক্লোরিন

             আমরা দুজনেই কিন্তু
         আড়াআড়ি ০ ও ১এর মাঝমাঝ সিম্ফনি  
         
              মোবাইলে অন্ধকারের রিংটোন বাজছে
------------------------------------------------------------------
শব্দরূপ : রাহুল

Tuesday, 18 April 2017

।। ভাড়া ।।


     একবছর হল ব্যাঙ্গালোরের সারজাপুর রোডের এই বাড়িতে ভাড়া থাকে সৌম্য,  সাথে নন্দিনী আর দুইসন্তান। বাড়িওয়ালা প্রতীক... প্রথম প্রথম সৌম্যর সাথে দারুণ কথাবার্তা  ছিল... মাসের শেষে ভাড়া আদায় ছাড়াও টুকটাক এদিকওদিক, হয়ে যেত... ধীরে ধীরে মাসের শেষে এসে কথাবার্তা সীমিত হয়। বছর ঘুরতেই নিয়ম অনুযায়ী নতুন রেন্টাল এগ্রীমেন্ট বানানোর সময়, প্রতীক পাঁচ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর কথা ফোনে সৌম্যকে জানায়। সৌম্যর আগেই মনে হত বড্ড বেশি ভাড়ায় নেওয়া হয়েছে এই বাড়িটা, তাই আর বাড়ানোর প্রশ্নই ওঠেনা। সৌম্য ফোনে প্রতীককে জানায়, ভাড়ার ব্যাপারে নন্দিনীর সাথে কথা বলে নেবেন একটু, আমি একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছি অফিসের বিশেষ কাজে...!!
     আপাত ভদ্র প্রতীক নন্দিনীকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে, কিন্তু নন্দিনী বাড়িটির নানারকম জলঘটিত, দরজা, রেগুলেটার, টপফ্লোরের অসুবিধা এবং আরো নানাবিধ সমস্যার কথা তুলে ভাড়া বাড়ানোর যেকোন সম্ভাবনা হেসেই উড়িয়ে দেয়। "ভাড়া বাড়বে, থাকতে হলে থাকুন.... না হলে..." এই কথাগুলো বলে উঠতে পারেনা প্রতীক মহিলাটিকে। বুঝতে পারে এইধরনের রূঢ়ভাষী সে হতে পারবেনা, অন্য কোন রাস্তা ভাবতে হবে। সন্ধ্যেবেলা.. নন্দিনী জানায় সৌম্যকে পুরো ঘটনা। মনে মনে খুব খুশি হয় সৌম্য নিজের বুদ্ধিমত্তায়। নন্দিনী এই ধরনের পরিস্থিতি খুবই ভাল সামলে দিতে পারে, আবারও প্রমাণ হল!!
      ব্যাঙ্গালোরের ইন্দিরানগর অঞ্চল... অফিস থেকে বাড়ি ফিরে ডিনার টেবিলে প্রতীক... কোণের চেয়ারটায় বসে অস্মিতা তিনবছরের ছেলেকে খাওয়াচ্ছে। বড্ড দুরন্ত বাচ্চা, অনেকক্ষণ সময় নেয় খেতে।  চুপচাপ বসে ভাবছে প্রতীক, কি করা যায়। হঠাৎ ছেলের দিকে তাকিয়ে বিদ্যুৎচমকের মতো একটা আইডিয়া আসে মাথায়, একদৌড়ে গিয়ে ল্যাপটপ্টা খুলে বসে প্রতীক, মুখে মৃদু হাসি। তার পরের কয়েকটা মুহূর্ত একাগ্রভাবে কিছু কাজ শেষ করে প্রতীক... ল্যাপটপ বন্ধ করে খুশি মনে ডিনার টেবিলে ফেরে প্রতীক, অনেকটা শান্ত আর চনমনে দেখায় ওকে।
     এদিকে সারজাপুর রোডের বাড়িতে সৌম্যর ল্যাপটপের খোলা স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একটা ইমেল.... প্রেরকের নাম..প্রথম গুপ্তা। বিষয়বস্তু অনেকটা এই রকম, মি. সৌম্য বসু, আমি প্রথম গুপ্তা, প্রতীক আমার পিসতুত ভাই। আপনার কথা প্রতীকের মুখে শুনেছি। এখন যে বাড়িটায় আপনি থাকেন,  সেইটা আমি এইমাসে প্রতীকের কাছ থেকে কিনে নিচ্ছি। প্রতীক আমেরিকায় চলে যাচ্ছে এবং বাড়িটা আমাকে বিক্রি করে যাচ্ছে। আপনার এইবারের এগ্রীমেন্টটা আমার সাথে হবে, আমি আপনাকে দিন দুয়েকের মধ্যেই ফোন করব। ইমেইলটা পেয়ে একটু চিন্তায় পড়ে সৌম্য নন্দিনী।
    অফিসে গাড়িটা পার্ক করে ব্যাগটা উঠিয়ে লিফটের দিকে যাওয়ার সময় ফোনটা আসে। আমি প্রথম বলছি, চিনতে পারছেন!! একটু অস্বস্তিতে পড়ে সৌম্য... আওয়াজটা শুনেই ওর মনে হয়েছিল চেনা আওয়াজ, এখন কেমন গুলিয়ে গেল। প্রথমকে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে সুপ্রভাত বলার পরে বিকেলে ফোন করতে  অনুরোধ করে, বলে, তখন গুছিয়ে কথা বলা যাবে, প্লিজ..। সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে বলে সৌম্য.... জানো নন্দিনী আওয়াজটা খুব চেনা মনে হল। ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে তখনই। প্রথমের ফোন, সোজা নন্দিনীকে ধরিয়ে দেয় সৌম্য। নন্দিনী কথা বলতে থাকে। নন্দিনীর মুখের চেহারায় মাঝে মাঝেই পরিবর্তন দেখতে পায় সৌম্য, কখনো বিরক্তিতে কুঁচকে যাওয়া, আবার কখনো হালকা মুচকি হাসি।
     ফোন রেখে হাসিতে ফেটে পড়ে নন্দিনী। সৌম্য কিছুই বুঝতে পারেনা... নন্দিনী হাসি ফাঁকে ফাঁকে যা বলে তার মর্মার্থ হল... প্রতীক নাম আর ফোন নাম্বার বদলে ফোন করেছে, এবং নন্দিনীর কোন সন্দেহ নেই এইটা প্রতীকের আওয়াজ... নিজে ভদ্রমানুষ, চাপ দিতে পারছেনা... তাই অন্যভাবে চেষ্টা করছে।  বুঝতে কিছুটা সময় নিলেও পুরো ব্যাপারটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয় সৌম্যর কাছে। তার মানে ইমেইল আইডিটাও হতে পারে নতুন বানানো। কেমন একটা বিরক্তি অথচ হাসি পায় সৌম্যর, একটু মজা করার ইচ্ছে হয়। ফোনটা নিয়ে প্রতীককে কল করে সে। ওপ্রান্তে ফোন ধরে প্রতীক যেন একটু হাঁপাচ্ছে, এখনো নিজেকে শান্ত করতে পারেনি....!!
     সৌম্য বলে, প্রতীক তোমার ভাই প্রথমের ফোন এসেছিল। ওকে নাকি তুমি বাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছ। তোমার কাছ থেকে তো আমি কিছুই শুনিনি, তাই জানতে ফোন করলাম। প্রতীক জানায় কথাটা সত্যি..!! কিছুক্ষণের নীরবতা... সৌম্য বলে....প্রতীক, মানুষটার ব্যবহার, কিছু মনে কোরোনা... মানে...  তোমার মতো ভাল মানুষের সাথে ডীল করে অভ্যেস হয়ে গেছে আমাদের তো.. তাই... তোমার ভাইকে বলে দিও যা কথা তোমার সাথে হয়েছে তাই...নাহলে অন্য বাড়ি দেখে নেব আমরা... !!! ফোন ছাড়ার পরে ভাবতে বসে প্রতীক... আমাকে ভালমানুশ বলে এরা, সুন্দর ব্যবহারও করে... ঝামেলা করেনা.... কটা টাকার জন্যে এইসব... কিন্তু সেটাই বা ছাড়ি কেন... সব গুলিয়ে যায় প্রতীকের।
     এদিকে প্রথমের অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিগ্ধ সৌম্য প্রতীকের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এদিকওদিক দেখতে থাকে... মামাতো - পিসতুত ভাই, থাকতেই পারে।  বাড়ির ছবি, স্ত্রী, পুত্র... একটা ছবিতে এসে চোখ আটকে যায় ওর, এই নন্দিনী এদিকে এসো তাড়াতাড়ি একবার। দুজনে মিলে দেখে পোস্টটা... ছেলের জন্মদিনের পোস্ট, অনেক লোক... ফুঁ দিয়ে ক্যান্ডেল নেভাচ্ছে প্রতীকের স্ত্রী অস্মিতা আর কোলে মিষ্টি ছেলে, সুদৃশ্য একটা কেক... কেকের ওপরে লেখা থ্রী ইয়ার, তার নিচে লেখা , " হ্যাপ্পি বার্থডে প্রথম"!!! কেমন চুপচাপ হয়ে যায় ওরা, পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও তেমন কোন অনুভূতি হয়না। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে,  হালকা হাসি খেলে যায় দুজনেরই মুখে। বেজে ওঠে মোবাইলটা, প্রতীকের ফোন!!
      ওপ্রান্ত থেকে প্রতীক বলে,  সৌম্য আমি প্রথমের সাথে কথা বলেছি, সরি, কোন খারাপ ব্যবহার হয়ে থাকলে। তোমাদের ভাড়া বাড়াতে হবেনা এইবার। পরে আবার কথা বলব আমরা, এখন রাখছি। সৌম্য বলে, আরে না না ঠিক আছে প্রতীক, সব ঠিক আছে... প্রতীকের পেছনে হালকা এক নারীকন্ঠ শোনা যায়... প্রথম জিদ মত করো বেটা, জলদি খা লো..!!! দিনসাতেক পরে মাসের শেষদিনে একটা এসএমএস পায় প্রতীক, পড়তে পড়তে বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে ওর। লেখা আছে, প্রতীক ভাড়া ডিপোসিট করে দিয়েছি তোমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রতিবারের মতো... পাঁচ শতাংশ বাড়িয়ে দিলাম ভাই,  কিছু মনে কোরোনা, তোমার সাথে দরকষাকষি করাই যেত... কিন্তু তিনবছরের প্রথমের সাথে করা গেলনা, হেরে গেলাম আমরা...!!!
_______________________________________
©অর্ণব ভট্টাচার্য

Thursday, 13 April 2017

।। ফুরিয়ে যাচ্ছে বলে ।।


ফুরিয়ে যাচ্ছে বলে কারো কোনো দুঃখ নেই
চালের কোনো দুঃখ নেই চিনি আছে আনন্দেই
দুধ বরং উথলে উঠছে ফুর্তিতে ভ্রূক্ষেপ নেই ডালের
ফুরিয়ে যাচ্ছে মানুষ যত হাহাকার তাদের

কবে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে মানুষ বুঝবে
কতো কম পথ তার হাঁটা হয়েছিল
আরো কতো দূর পথ বাকি
এতটা বিষাদ নিয়ে সে কি করে যুঝবে
কবে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে মানুষ বুঝবে

আমিও একদিন ফুরিয়ে যাব — কিছুই নেই যে দরকারি
ছয় গজ কাপড় ছাড়া , চাই কি কিছু , তবে কেন হে মারামারি
যা পেয়েছি , এই  বা কজন পায় ,যদি এটাই ভাবতে পারি
উত্তর নেই—প্রশ্নই পর পর
হিসেব মেলানো ঝকমারি

আমিও একদিন ফুরিয়ে যাব—চিন্তা কেন কবির
জলের কোনো দুঃখ নেই—ভ্রূক্ষেপ নেই নদীর
পাখিরা গান গেয়ে যায় , সুবাতাস বয়ে যায় শান্ত ধীর
হাসতে হাসতে আমিও চলেছি পেছনে ফেলে শান্তির নীড়
আনন্দ চারিধারে , বিলিয়ে দাও অন্যদের মাঝে  নিজেকে
আমি সুখী সব পেয়েছি , নিজের মতো করে থাকতে দাও আমাকে  ।

**************************************
© কাজল ঘোষ /কবি ঘর /সল্ট লেক /কলকাতা

Wednesday, 12 April 2017

।। চার ইয়ারি গপ্পো ।।

রাতুল অতি ব্যস্ত হয়ে কিছু একটা খুঁজছিল । তার পরনে একটা ভিজে গামছা । সে একটু আগেই মেসের ছোট্ট পুকুরটাতে স্নান করেছে । পুকুর বলা ভুল - সেটা আসলে একটা ডোবা, শ্যাওলা জমে জল দেখা যায় না । রাতুল একাই তাতে আয়েশ করে  স্নান করে । মেসের অন্য বন্ধুরা অনেকবার বারন করেছে । প্রতিবারই রাতুল হাসি মুখে জবাব দিয়েছে
- ব্যামো হলে আমার হবে, তোদের চিন্তা কী !

এই ঘরটি বেশ বড়ো, রাতুল ছাড়াও আরও তিনজন থাকে । নাসির,  জয়ন্ত ও শুভ । সকলেই সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র, নাসির  বাংলা বিভাগ । বাকি তিনজন ইতিহাসের ।

জয়ন্ত বাইরে গেছে । শুভ এই গরমের দিনেও চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে । নাসির  নিজের টেবিলে বসে "শার্লক হোমস"  পড়ছিল । সে সিলেবাস অপেক্ষা  অন্য নানা রকম রহস্য  বই পড়তে বেশি ভালোবাসে।
রাতুলের ফোনটা বেজেই চলেছে । মিতুর ফোন । রাতুল ফোন তুলছে না । আজ তাদের এক সাথে সিনেমা দেখার কথা । ফোন তুললেই মিতু বকুনি দেবে, তারপর চলে যাবে । তার চেয়ে বরং অপেক্ষা করুক ।

রাতুলকে ব্যস্ত দেখে নাসির কৌতুহলে জিগ্যেস করলো
- কিরে কি হয়েছে !
রাতুল বিরক্তের সাথে উত্তর দিল
- আরে ধুর খুঁজে পাচ্ছি না । এখানেই রেখেছিলাম । এদিকে একটা  বাজতে চলেছে । মিতু আমাকে মেরেই ফেলবে ।  কালই কিনেছি । এখনও স্টিকার তুলিনি ।

- কি  জাঙ্গিয়া? 
- হ্যাঁ
- লাল রঙের তো?
- আরে হ্যাঁ , তুই দেখেছিস?

নাসির বইটা বন্ধ করে একটু ভাবের সাথে বললো
-হুম ।
রাতুল বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছিল পরবর্তী কথাটা শোনার জন্য । কিন্তু নাসির কোনও কথা না বলে তার প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট টা বার করে টেবিলের উপর রাখলো । তারপর রাতুলের পিছনে জয়ন্তর টেবিলের দিকে আঙুল নির্দেশ করে ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো
- এই দেশলাই টা একটু দে তো ।

রাতুলের ইচ্ছে করছিল আমেরিকার বোমার মতো ফেটে পড়তে । কিন্তু হঠাৎই একটা ব্যাপার মাথায় আসতেই সে নাসিরের দুই বগলের তলাই বিশ্রী ভঙ্গিতে কাতুকুতু দিতে লাগল ।
- ব্যাটা  শার্লক হোমস হয়েছো,  জাঙ্গিয়ার  তদন্ত করবে ।
এই নে আগাম পারিশ্রমিক ।

নাসির ছেলেটা এই জগত সংসারে যে একটা ব্যাপারকেই ভয় পায় সেটা হলো  কাতুকুতু । সে হো হো করে ঘর কাঁপিয়ে বাবা রে মা রে করতে থাকে । নাসিরের হাসির শব্দে পাশে শুয়ে থাকা শুভ ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠে । কিছু না বুঝেই লাফিয়ে লাফিয়ে  হাঁকতে থাকে
- কি কাকে….. কেন... কখন !

রাতুল নাসির কে ছেড়ে দিয়ে শুভোর দিকে তাকালো ।
- এই লাফাচ্ছিস কেন।
রাতুলের কথাতে শুভ শান্ত হয়ে । মুখের দিকে তাকালো । তারপর নিচে মেঝের দিকে তাকালো । মেঝেতে নাসির শুয়ে আছে । সে একটা মিহি শব্দে  হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে ।
ব্যপারটা কিছুটা বুঝতে পেরে শুভ 'ধুট ' বলে  পুনরায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো ।

এই ব্যাটা ওঠ। বলে নাসির কে  তুলে চেয়ারে বসালো । নাসির ভয়ে ভয়ে দু হাত দিয়ে বাঁধা দেওয়ার  ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে   জড়ানো  গলাই  কি একটা অস্পষ্ট  কথা পরপর দুবার বললো ।
রাতুল বুঝতে পেরে বললো
- কী  ! জয়ন্ত পরে গেছে!  কখন!  কোথায় গেছে । তুই ঠিক দেখেছিস তো ।
নাসির হাসতে হাসতে দুবার মাথা উঁচু নিচু করে উত্তর দিল ।
রাতুলের  এবার যেন কান্না পাচ্ছে ।
- হারামজাদা জয়ন্ত । শালার মটু । আমার কোমর কোথায় বত্রিশ আর  ওর  কোথায় ছত্রিশ । আমার জাঙ্গিয়া ও কিভাবে পড়লো । শালা হারামী এর আগে একবার আমার স্যান্ড গেঞ্জি পড়েছিল । এখন সেটা হাতিকে পড়ানোর মতো অবস্থা ।

দড়িতে ঝুলতে  থাকা পুরানো একটা জাঙ্গিয়া প্যান্ট নিয়ে পড়তে পড়তে নাসির কে বললো 
- কোথায় গেছে জানিস ।
নাসিরের এতক্ষণে হাসি থেমেছে । সে একটা বড়ো প্রশ্বাস নিয়ে বললো
- জানি না,  তবে ফোনে কথা বলছিলো । বোধহয় ডেটিং টেটিং  হবে । সম্ভবত  নতুন কোনও মেয়ে ।

রাতুল প্যান্ট জামা পড়ে নিয়ে চুলে চিরুনি দিতে দিতে বললো
- শালা । আমার জাঙ্গিয়া পড়ে ডেটিং । অন্যের জিনিসে থাবা ! একবার আসুক  জামার ভিতরে যদি না লঙ্কার গুড়ো দিয়েছি  তো আমার নামও রাতুল না ।

একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে 'একটা পনেরো' দেখেই তড়িঘড়ি
তার বেডের তলা থেকে জুতোর বাক্সটা বার করলো । জুতোর অবস্থা দেখে হতাশ হলো সে । চামড়ার বুট,  তিন বছর না হতেই কি বিশ্রী দশা হয়েছে । রাতুল কি যেন ভেবে নাসিরের দিকে তাকালো একবার । নাসির আগের মতো টেবিলে  বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে । রাতুল পিছনে ঘুরে  একবার শুভোর দিকে তাকালো । শুভ দিব্বি চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে । রাতুল খুব সাবধানে শুভোর বেডের নিচ থেকে তার নতুন কেনা চকচকে বুট জোড়া বার করলো । তারপর ধিরে ধিরে পা গলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ।

রুপোলি সিনেমা হলে এসে যখন গাড়ি থেকে  নামলো তখন শো শুরু হয়ে গিয়েছে । হলের সামনে  তিনটি কুকুর ছাড়া  কোনও প্রাণী নেই । রাতুল ফোন বার করে দেখলো দুটো এসএমএস  নটা মিসকল । সবই মিতুর । রাতুল এসএমএস দুটো ওপেন করলো । একটাতে লেখা
" বজ্জাত ছেলে "
অন্যটিতে লেখা  " কখনো যেন আমাকে ফোন করবে না, যদি ফোন করো তবে তুমি একটা আরশোলা " ।

রাতুল সাথে সাথেই  ফোন করলো । কিন্তু সুইচ অফ বলছে ।
রাগে তার শরীর পুড়ছে । জয়ন্তকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে । ওর কারণেই এমনটা হলো । না জানি কতদিন ভোগাবে মিতু ।
মাথার উপর হিংসুটে রোদ্দুর- শরীর ঘামছে তার । হলের পিছনের দিকে ইছামতীর ধারে বড়ো পার্কটার কথা মনে হলো । তাছাড়া প্রচণ্ড ক্ষুধা ও পেয়েছে তার ।
পার্কের কাছে একটা বিহারী বিরিয়ানির  হোটেল আছে । খুব ভালো হোটেল । রাতুলরা  যখনই  এই দিকটাতে আসে বিরিয়ানি না খেয়ে যায় না । রাতুল  পকেট থেকে রুমালটা বার করে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে হোটেলের উদ্দেশ্যে  হাঁটা শুরু করলো ।

হোটেলের বেসিনে হাত ধুতে ধুতে  সে লক্ষ্য করলো  তার সামনে কিছু দূরে । একটি ছেলে  তার দিকে হাত দুটো মুখের সামনে ধরে  নমস্কারের ভঙ্গিতে ক্ষমা চাওয়ার মতো করছে  । তার সামনে উল্টো দিকে মুখ করে মাথা নিচু করে একটি মেয়ে বসে আছে । বিরিয়ানি খাচ্ছে ।  ছেলেটার মুখের সামনে থেকে হাত দুটো একটু ডান পাশে সরতেই রাতুল বুঝতে পারলো যে সেটা আর কেউ নয় ব্যাটা  জয়ন্ত ।
  __________
© রু দ্র  র বি