একবছর হল ব্যাঙ্গালোরের সারজাপুর রোডের এই বাড়িতে ভাড়া থাকে সৌম্য, সাথে নন্দিনী আর দুইসন্তান। বাড়িওয়ালা প্রতীক... প্রথম প্রথম সৌম্যর সাথে দারুণ কথাবার্তা ছিল... মাসের শেষে ভাড়া আদায় ছাড়াও টুকটাক এদিকওদিক, হয়ে যেত... ধীরে ধীরে মাসের শেষে এসে কথাবার্তা সীমিত হয়। বছর ঘুরতেই নিয়ম অনুযায়ী নতুন রেন্টাল এগ্রীমেন্ট বানানোর সময়, প্রতীক পাঁচ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর কথা ফোনে সৌম্যকে জানায়। সৌম্যর আগেই মনে হত বড্ড বেশি ভাড়ায় নেওয়া হয়েছে এই বাড়িটা, তাই আর বাড়ানোর প্রশ্নই ওঠেনা। সৌম্য ফোনে প্রতীককে জানায়, ভাড়ার ব্যাপারে নন্দিনীর সাথে কথা বলে নেবেন একটু, আমি একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছি অফিসের বিশেষ কাজে...!!
আপাত ভদ্র প্রতীক নন্দিনীকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে, কিন্তু নন্দিনী বাড়িটির নানারকম জলঘটিত, দরজা, রেগুলেটার, টপফ্লোরের অসুবিধা এবং আরো নানাবিধ সমস্যার কথা তুলে ভাড়া বাড়ানোর যেকোন সম্ভাবনা হেসেই উড়িয়ে দেয়। "ভাড়া বাড়বে, থাকতে হলে থাকুন.... না হলে..." এই কথাগুলো বলে উঠতে পারেনা প্রতীক মহিলাটিকে। বুঝতে পারে এইধরনের রূঢ়ভাষী সে হতে পারবেনা, অন্য কোন রাস্তা ভাবতে হবে। সন্ধ্যেবেলা.. নন্দিনী জানায় সৌম্যকে পুরো ঘটনা। মনে মনে খুব খুশি হয় সৌম্য নিজের বুদ্ধিমত্তায়। নন্দিনী এই ধরনের পরিস্থিতি খুবই ভাল সামলে দিতে পারে, আবারও প্রমাণ হল!!
ব্যাঙ্গালোরের ইন্দিরানগর অঞ্চল... অফিস থেকে বাড়ি ফিরে ডিনার টেবিলে প্রতীক... কোণের চেয়ারটায় বসে অস্মিতা তিনবছরের ছেলেকে খাওয়াচ্ছে। বড্ড দুরন্ত বাচ্চা, অনেকক্ষণ সময় নেয় খেতে। চুপচাপ বসে ভাবছে প্রতীক, কি করা যায়। হঠাৎ ছেলের দিকে তাকিয়ে বিদ্যুৎচমকের মতো একটা আইডিয়া আসে মাথায়, একদৌড়ে গিয়ে ল্যাপটপ্টা খুলে বসে প্রতীক, মুখে মৃদু হাসি। তার পরের কয়েকটা মুহূর্ত একাগ্রভাবে কিছু কাজ শেষ করে প্রতীক... ল্যাপটপ বন্ধ করে খুশি মনে ডিনার টেবিলে ফেরে প্রতীক, অনেকটা শান্ত আর চনমনে দেখায় ওকে।
এদিকে সারজাপুর রোডের বাড়িতে সৌম্যর ল্যাপটপের খোলা স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একটা ইমেল.... প্রেরকের নাম..প্রথম গুপ্তা। বিষয়বস্তু অনেকটা এই রকম, মি. সৌম্য বসু, আমি প্রথম গুপ্তা, প্রতীক আমার পিসতুত ভাই। আপনার কথা প্রতীকের মুখে শুনেছি। এখন যে বাড়িটায় আপনি থাকেন, সেইটা আমি এইমাসে প্রতীকের কাছ থেকে কিনে নিচ্ছি। প্রতীক আমেরিকায় চলে যাচ্ছে এবং বাড়িটা আমাকে বিক্রি করে যাচ্ছে। আপনার এইবারের এগ্রীমেন্টটা আমার সাথে হবে, আমি আপনাকে দিন দুয়েকের মধ্যেই ফোন করব। ইমেইলটা পেয়ে একটু চিন্তায় পড়ে সৌম্য নন্দিনী।
অফিসে গাড়িটা পার্ক করে ব্যাগটা উঠিয়ে লিফটের দিকে যাওয়ার সময় ফোনটা আসে। আমি প্রথম বলছি, চিনতে পারছেন!! একটু অস্বস্তিতে পড়ে সৌম্য... আওয়াজটা শুনেই ওর মনে হয়েছিল চেনা আওয়াজ, এখন কেমন গুলিয়ে গেল। প্রথমকে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে সুপ্রভাত বলার পরে বিকেলে ফোন করতে অনুরোধ করে, বলে, তখন গুছিয়ে কথা বলা যাবে, প্লিজ..। সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে বলে সৌম্য.... জানো নন্দিনী আওয়াজটা খুব চেনা মনে হল। ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে তখনই। প্রথমের ফোন, সোজা নন্দিনীকে ধরিয়ে দেয় সৌম্য। নন্দিনী কথা বলতে থাকে। নন্দিনীর মুখের চেহারায় মাঝে মাঝেই পরিবর্তন দেখতে পায় সৌম্য, কখনো বিরক্তিতে কুঁচকে যাওয়া, আবার কখনো হালকা মুচকি হাসি।
ফোন রেখে হাসিতে ফেটে পড়ে নন্দিনী। সৌম্য কিছুই বুঝতে পারেনা... নন্দিনী হাসি ফাঁকে ফাঁকে যা বলে তার মর্মার্থ হল... প্রতীক নাম আর ফোন নাম্বার বদলে ফোন করেছে, এবং নন্দিনীর কোন সন্দেহ নেই এইটা প্রতীকের আওয়াজ... নিজে ভদ্রমানুষ, চাপ দিতে পারছেনা... তাই অন্যভাবে চেষ্টা করছে। বুঝতে কিছুটা সময় নিলেও পুরো ব্যাপারটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয় সৌম্যর কাছে। তার মানে ইমেইল আইডিটাও হতে পারে নতুন বানানো। কেমন একটা বিরক্তি অথচ হাসি পায় সৌম্যর, একটু মজা করার ইচ্ছে হয়। ফোনটা নিয়ে প্রতীককে কল করে সে। ওপ্রান্তে ফোন ধরে প্রতীক যেন একটু হাঁপাচ্ছে, এখনো নিজেকে শান্ত করতে পারেনি....!!
সৌম্য বলে, প্রতীক তোমার ভাই প্রথমের ফোন এসেছিল। ওকে নাকি তুমি বাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছ। তোমার কাছ থেকে তো আমি কিছুই শুনিনি, তাই জানতে ফোন করলাম। প্রতীক জানায় কথাটা সত্যি..!! কিছুক্ষণের নীরবতা... সৌম্য বলে....প্রতীক, মানুষটার ব্যবহার, কিছু মনে কোরোনা... মানে... তোমার মতো ভাল মানুষের সাথে ডীল করে অভ্যেস হয়ে গেছে আমাদের তো.. তাই... তোমার ভাইকে বলে দিও যা কথা তোমার সাথে হয়েছে তাই...নাহলে অন্য বাড়ি দেখে নেব আমরা... !!! ফোন ছাড়ার পরে ভাবতে বসে প্রতীক... আমাকে ভালমানুশ বলে এরা, সুন্দর ব্যবহারও করে... ঝামেলা করেনা.... কটা টাকার জন্যে এইসব... কিন্তু সেটাই বা ছাড়ি কেন... সব গুলিয়ে যায় প্রতীকের।
এদিকে প্রথমের অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিগ্ধ সৌম্য প্রতীকের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এদিকওদিক দেখতে থাকে... মামাতো - পিসতুত ভাই, থাকতেই পারে। বাড়ির ছবি, স্ত্রী, পুত্র... একটা ছবিতে এসে চোখ আটকে যায় ওর, এই নন্দিনী এদিকে এসো তাড়াতাড়ি একবার। দুজনে মিলে দেখে পোস্টটা... ছেলের জন্মদিনের পোস্ট, অনেক লোক... ফুঁ দিয়ে ক্যান্ডেল নেভাচ্ছে প্রতীকের স্ত্রী অস্মিতা আর কোলে মিষ্টি ছেলে, সুদৃশ্য একটা কেক... কেকের ওপরে লেখা থ্রী ইয়ার, তার নিচে লেখা , " হ্যাপ্পি বার্থডে প্রথম"!!! কেমন চুপচাপ হয়ে যায় ওরা, পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও তেমন কোন অনুভূতি হয়না। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে, হালকা হাসি খেলে যায় দুজনেরই মুখে। বেজে ওঠে মোবাইলটা, প্রতীকের ফোন!!
ওপ্রান্ত থেকে প্রতীক বলে, সৌম্য আমি প্রথমের সাথে কথা বলেছি, সরি, কোন খারাপ ব্যবহার হয়ে থাকলে। তোমাদের ভাড়া বাড়াতে হবেনা এইবার। পরে আবার কথা বলব আমরা, এখন রাখছি। সৌম্য বলে, আরে না না ঠিক আছে প্রতীক, সব ঠিক আছে... প্রতীকের পেছনে হালকা এক নারীকন্ঠ শোনা যায়... প্রথম জিদ মত করো বেটা, জলদি খা লো..!!! দিনসাতেক পরে মাসের শেষদিনে একটা এসএমএস পায় প্রতীক, পড়তে পড়তে বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে ওর। লেখা আছে, প্রতীক ভাড়া ডিপোসিট করে দিয়েছি তোমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রতিবারের মতো... পাঁচ শতাংশ বাড়িয়ে দিলাম ভাই, কিছু মনে কোরোনা, তোমার সাথে দরকষাকষি করাই যেত... কিন্তু তিনবছরের প্রথমের সাথে করা গেলনা, হেরে গেলাম আমরা...!!!
_______________________________________
©অর্ণব ভট্টাচার্য
আমরা সবাই তৃতীয় বিশ্বের জীবনযুদ্ধের পদাতিক সেনা। যেখানে উদয়াস্ত পরিশ্রমের মাঝে ব্যাক্তিগত শখ পূরনের পরিসর খুবই স্বল্প। এর পরেও কিছু মানুষ তাদের মনের ভাবনাগুলোকে অক্ষরের ভাষাতে ফুটিয়ে তোলেন। হয়ত অপটু হাতেই, কিন্তু সেটা ভাবনার পরিষ্ফুটনের পথে কোন বাঁধা নয়। আর সেই সকল মৌলিক লেখনিকে সম্মান জানাতে তার থেকে কিছু নির্বাচিত নির্যাস দিয়ে সাজানো আমাদের এই "নির্বাচিত অকপট লিপি"
Tuesday, 18 April 2017
।। ভাড়া ।।
Labels:
অনুগল্প,
অর্ণব ভট্টাচার্য্য
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment