রাতুল অতি ব্যস্ত হয়ে কিছু একটা খুঁজছিল । তার পরনে একটা ভিজে গামছা । সে একটু আগেই মেসের ছোট্ট পুকুরটাতে স্নান করেছে । পুকুর বলা ভুল - সেটা আসলে একটা ডোবা, শ্যাওলা জমে জল দেখা যায় না । রাতুল একাই তাতে আয়েশ করে স্নান করে । মেসের অন্য বন্ধুরা অনেকবার বারন করেছে । প্রতিবারই রাতুল হাসি মুখে জবাব দিয়েছে
- ব্যামো হলে আমার হবে, তোদের চিন্তা কী !
এই ঘরটি বেশ বড়ো, রাতুল ছাড়াও আরও তিনজন থাকে । নাসির, জয়ন্ত ও শুভ । সকলেই সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র, নাসির বাংলা বিভাগ । বাকি তিনজন ইতিহাসের ।
জয়ন্ত বাইরে গেছে । শুভ এই গরমের দিনেও চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে । নাসির নিজের টেবিলে বসে "শার্লক হোমস" পড়ছিল । সে সিলেবাস অপেক্ষা অন্য নানা রকম রহস্য বই পড়তে বেশি ভালোবাসে।
রাতুলের ফোনটা বেজেই চলেছে । মিতুর ফোন । রাতুল ফোন তুলছে না । আজ তাদের এক সাথে সিনেমা দেখার কথা । ফোন তুললেই মিতু বকুনি দেবে, তারপর চলে যাবে । তার চেয়ে বরং অপেক্ষা করুক ।
রাতুলকে ব্যস্ত দেখে নাসির কৌতুহলে জিগ্যেস করলো
- কিরে কি হয়েছে !
রাতুল বিরক্তের সাথে উত্তর দিল
- আরে ধুর খুঁজে পাচ্ছি না । এখানেই রেখেছিলাম । এদিকে একটা বাজতে চলেছে । মিতু আমাকে মেরেই ফেলবে । কালই কিনেছি । এখনও স্টিকার তুলিনি ।
- কি জাঙ্গিয়া?
- হ্যাঁ
- লাল রঙের তো?
- আরে হ্যাঁ , তুই দেখেছিস?
নাসির বইটা বন্ধ করে একটু ভাবের সাথে বললো
-হুম ।
রাতুল বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছিল পরবর্তী কথাটা শোনার জন্য । কিন্তু নাসির কোনও কথা না বলে তার প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট টা বার করে টেবিলের উপর রাখলো । তারপর রাতুলের পিছনে জয়ন্তর টেবিলের দিকে আঙুল নির্দেশ করে ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো
- এই দেশলাই টা একটু দে তো ।
রাতুলের ইচ্ছে করছিল আমেরিকার বোমার মতো ফেটে পড়তে । কিন্তু হঠাৎই একটা ব্যাপার মাথায় আসতেই সে নাসিরের দুই বগলের তলাই বিশ্রী ভঙ্গিতে কাতুকুতু দিতে লাগল ।
- ব্যাটা শার্লক হোমস হয়েছো, জাঙ্গিয়ার তদন্ত করবে ।
এই নে আগাম পারিশ্রমিক ।
নাসির ছেলেটা এই জগত সংসারে যে একটা ব্যাপারকেই ভয় পায় সেটা হলো কাতুকুতু । সে হো হো করে ঘর কাঁপিয়ে বাবা রে মা রে করতে থাকে । নাসিরের হাসির শব্দে পাশে শুয়ে থাকা শুভ ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠে । কিছু না বুঝেই লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁকতে থাকে
- কি কাকে….. কেন... কখন !
রাতুল নাসির কে ছেড়ে দিয়ে শুভোর দিকে তাকালো ।
- এই লাফাচ্ছিস কেন।
রাতুলের কথাতে শুভ শান্ত হয়ে । মুখের দিকে তাকালো । তারপর নিচে মেঝের দিকে তাকালো । মেঝেতে নাসির শুয়ে আছে । সে একটা মিহি শব্দে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে ।
ব্যপারটা কিছুটা বুঝতে পেরে শুভ 'ধুট ' বলে পুনরায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো ।
এই ব্যাটা ওঠ। বলে নাসির কে তুলে চেয়ারে বসালো । নাসির ভয়ে ভয়ে দু হাত দিয়ে বাঁধা দেওয়ার ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে জড়ানো গলাই কি একটা অস্পষ্ট কথা পরপর দুবার বললো ।
রাতুল বুঝতে পেরে বললো
- কী ! জয়ন্ত পরে গেছে! কখন! কোথায় গেছে । তুই ঠিক দেখেছিস তো ।
নাসির হাসতে হাসতে দুবার মাথা উঁচু নিচু করে উত্তর দিল ।
রাতুলের এবার যেন কান্না পাচ্ছে ।
- হারামজাদা জয়ন্ত । শালার মটু । আমার কোমর কোথায় বত্রিশ আর ওর কোথায় ছত্রিশ । আমার জাঙ্গিয়া ও কিভাবে পড়লো । শালা হারামী এর আগে একবার আমার স্যান্ড গেঞ্জি পড়েছিল । এখন সেটা হাতিকে পড়ানোর মতো অবস্থা ।
দড়িতে ঝুলতে থাকা পুরানো একটা জাঙ্গিয়া প্যান্ট নিয়ে পড়তে পড়তে নাসির কে বললো
- কোথায় গেছে জানিস ।
নাসিরের এতক্ষণে হাসি থেমেছে । সে একটা বড়ো প্রশ্বাস নিয়ে বললো
- জানি না, তবে ফোনে কথা বলছিলো । বোধহয় ডেটিং টেটিং হবে । সম্ভবত নতুন কোনও মেয়ে ।
রাতুল প্যান্ট জামা পড়ে নিয়ে চুলে চিরুনি দিতে দিতে বললো
- শালা । আমার জাঙ্গিয়া পড়ে ডেটিং । অন্যের জিনিসে থাবা ! একবার আসুক জামার ভিতরে যদি না লঙ্কার গুড়ো দিয়েছি তো আমার নামও রাতুল না ।
একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে 'একটা পনেরো' দেখেই তড়িঘড়ি
তার বেডের তলা থেকে জুতোর বাক্সটা বার করলো । জুতোর অবস্থা দেখে হতাশ হলো সে । চামড়ার বুট, তিন বছর না হতেই কি বিশ্রী দশা হয়েছে । রাতুল কি যেন ভেবে নাসিরের দিকে তাকালো একবার । নাসির আগের মতো টেবিলে বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে । রাতুল পিছনে ঘুরে একবার শুভোর দিকে তাকালো । শুভ দিব্বি চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে । রাতুল খুব সাবধানে শুভোর বেডের নিচ থেকে তার নতুন কেনা চকচকে বুট জোড়া বার করলো । তারপর ধিরে ধিরে পা গলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ।
রুপোলি সিনেমা হলে এসে যখন গাড়ি থেকে নামলো তখন শো শুরু হয়ে গিয়েছে । হলের সামনে তিনটি কুকুর ছাড়া কোনও প্রাণী নেই । রাতুল ফোন বার করে দেখলো দুটো এসএমএস নটা মিসকল । সবই মিতুর । রাতুল এসএমএস দুটো ওপেন করলো । একটাতে লেখা
" বজ্জাত ছেলে "
অন্যটিতে লেখা " কখনো যেন আমাকে ফোন করবে না, যদি ফোন করো তবে তুমি একটা আরশোলা " ।
রাতুল সাথে সাথেই ফোন করলো । কিন্তু সুইচ অফ বলছে ।
রাগে তার শরীর পুড়ছে । জয়ন্তকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে । ওর কারণেই এমনটা হলো । না জানি কতদিন ভোগাবে মিতু ।
মাথার উপর হিংসুটে রোদ্দুর- শরীর ঘামছে তার । হলের পিছনের দিকে ইছামতীর ধারে বড়ো পার্কটার কথা মনে হলো । তাছাড়া প্রচণ্ড ক্ষুধা ও পেয়েছে তার ।
পার্কের কাছে একটা বিহারী বিরিয়ানির হোটেল আছে । খুব ভালো হোটেল । রাতুলরা যখনই এই দিকটাতে আসে বিরিয়ানি না খেয়ে যায় না । রাতুল পকেট থেকে রুমালটা বার করে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে হোটেলের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলো ।
হোটেলের বেসিনে হাত ধুতে ধুতে সে লক্ষ্য করলো তার সামনে কিছু দূরে । একটি ছেলে তার দিকে হাত দুটো মুখের সামনে ধরে নমস্কারের ভঙ্গিতে ক্ষমা চাওয়ার মতো করছে । তার সামনে উল্টো দিকে মুখ করে মাথা নিচু করে একটি মেয়ে বসে আছে । বিরিয়ানি খাচ্ছে । ছেলেটার মুখের সামনে থেকে হাত দুটো একটু ডান পাশে সরতেই রাতুল বুঝতে পারলো যে সেটা আর কেউ নয় ব্যাটা জয়ন্ত ।
__________
© রু দ্র র বি
No comments:
Post a Comment